‘প্রসিকিউশন বলেছে গ্রেপ্তার, আমরা বলি আত্মসমর্পণ’: ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে আসামিপক্ষের আইনজীবী

আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন সেনা কর্মকর্তারা—এমন মন্তব্য করেছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম সারোয়ার হোসেন। বুধবার (২২ অক্টোবর) সকালে সেনা হেফাজতে থাকা ১৫ কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশের পর তিনি এই বক্তব্য দেন।

সারোয়ার হোসেন জানান, গত ৮ অক্টোবর তিনটি মামলায় ট্রাইব্যুনালে আদেশ হয়, যেখানে বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। এরপর সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের হেফাজতে নেয় এবং আজ (২২ অক্টোবর) সেই মামলাগুলোর শুনানির নির্ধারিত তারিখ ছিল।

তিনি বলেন, “এই তারিখে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তারা আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। আদালত আমাদের ওকালতনামা গ্রহণ করেছে এবং তিনটি আবেদন জমা দেওয়া হয়েছে, যার একটি জামিনের। পাশাপাশি প্রিভিলেজ কমিউনিকেশন এবং সাবজেলে রাখার আবেদনও করা হয়েছে।”

সাবজেল প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার সারোয়ার বলেন, “এ ব্যাপারে জেল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবেন। যারা এখনো পলাতক আছেন, তাদের জন্য ২০ নভেম্বর শুনানির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সেনানিবাসে ঘোষিত সাবজেলে তাদের রাখা হবে।”

তিনি আরও বলেন, “টেকনিক্যালি প্রসিকিউশন বলেছে ‘গ্রেপ্তার’, কিন্তু আমরা বলি ‘আত্মসমর্পণ’। কারণ তারা স্বেচ্ছায় আদালতে এসেছেন, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেনি। প্রশাসনিক সুবিধা ও নিরাপত্তার কারণে শুধু একটি গাড়িতে আনা হয়েছে। তারা প্রকৃতপক্ষে আত্মসমর্পণ করেছে।”

এদিন সকাল ৮টার পর তিন মামলার শুনানি শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। শুনানি শেষে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার-এর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ ১৫ কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

প্রেস ব্রিফিংয়ে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “আজ তিনটি মামলার মোট ১৫ আসামিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করেছে।” এর মধ্যে র‌্যাব-এর টিএফআই সেলে গুম-নির্যাতনের অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ১৭ আসামির মধ্যে ১০ জনকে আনা হয় এবং তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।

এছাড়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ পলাতক আসামিদের হাজির হওয়ার জন্য দুটি জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। এই বিজ্ঞপ্তি ২৯ অক্টোবরের মধ্যে প্রকাশ করতে বলা হয়েছে। পরবর্তী শুনানির দিন নির্ধারণ করা হয়েছে ২০ নভেম্বর।

জেআইসি বা জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে গুমের অভিযোগে দায়ের হওয়া আরেক মামলায় ১৩ আসামির মধ্যে তিনজনকে হাজির করা হয়। তাদের বিরুদ্ধেও একই আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল এবং পলাতকদের ব্যাপারে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন। এই মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখও ২০ নভেম্বর।

অন্যদিকে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় রাজধানীর রামপুরায় ২৮ জনকে হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় উপস্থিত দুজন আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় দুই আসামি পলাতক থাকায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং পরবর্তী শুনানির জন্য ৫ নভেম্বর তারিখ ধার্য করা হয়।

এর আগে, গত ৮ অক্টোবর তিনটি মামলায় মোট ৩৪ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। অভিযোগ আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে এবং ২২ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করে। এই তিন মামলায় একটিতে ১৭, অন্যটিতে ১৩ এবং তৃতীয়টিতে ৪ জনকে আসামি করা হয়েছে, যার দুটিতে শেখ হাসিনার নাম রয়েছে। এসব মামলায় ২৫ জনই সেনা কর্মকর্তা। সেনাসদর জানিয়েছে, অভিযোগ আমলে নেওয়ার পর ১১ অক্টোবর ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়।

১৫ সেনা কর্মকর্তার তালিকায় রয়েছেন—র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, ব্রিগেডিয়ার কেএম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসরকালীন ছুটিতে), র‌্যাব গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম, বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা মেজর মো. রাফাত বিন আলম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।

এদিকে, সেনা কর্মকর্তাদের আদালতে হাজিরের সময় রাজধানীর কাকরাইল, মৎস্য ভবন, পল্টনসহ বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা লক্ষ্য করা যায়। ভোর থেকেই ট্রাইব্যুনাল ও হাইকোর্ট এলাকার মাজারগেটের আশপাশে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *