গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)। সেই ফ্যাসিবাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের দিনটি শুধু রাজনৈতিক ইতিহাসেই নয়, বরং রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতেও গভীর নাড়া দেয়। হাসিনার দেশত্যাগের খবরে সবচেয়ে বেশি হতবাক হন তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী (Dr. Shirin Sharmin Chaudhury)।
সংসদ ভবন এলাকায় দায়িত্ব পালনরত এক কর্মকর্তা জানান, ৫ আগস্টের সেই সকাল পর্যন্ত শিরীন শারমিন সংসদ ভবনের পশ্চিম পাশের লেকপাড়ের সরকারি বাসভবনেই অবস্থান করছিলেন। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই অস্বাভাবিক হয়ে উঠলেও তাকে কোনোভাবেই বিচলিত দেখা যায়নি। বরং ওই দিনও তিনি দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন, বিভিন্ন ফাইলে সই করেন এবং নিয়মিত অফিসিয়াল রুটিন মেনে কাজ চালিয়ে যান।
তবে দুপুর গড়িয়ে গেলে পরিস্থিতি বদলে যায়। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা যখন গণভবন ও সংসদ ভবন অভিমুখে রওনা দেন, তখন স্পিকারকে বিষয়টি জানানো হয়। মুহূর্তের মধ্যেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন সংসদ এলাকা ছাড়ার। নিরাপত্তারক্ষী ও প্রটোকল কর্মকর্তাদের রেখে নিজের ব্যক্তিগত গাড়িতে দ্রুত বেরিয়ে পড়েন তিনি। সঙ্গে ছিলেন স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক হোসাইন ও ছোট ছেলে। ১২ বছর ধরে থাকা সংসদ ভবন এলাকার সেই সরকারি বাসভবন ত্যাগের সময় তার মুখে ছিল নিস্তব্ধতা—বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে পারেন।
এরপর থেকে শিরীন শারমিনের কোনো হদিস মেলেনি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে তার অবস্থান সম্পর্কেও নেই স্পষ্ট কোনো তথ্য। যদিও সরকারি ও রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন—তিনি নাকি স্বামীসহ সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন।
তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া হত্যা মামলার তদন্ত এক বছর পেরিয়ে গেলেও শেষ হয়নি। এই অনিশ্চয়তা নিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে টানাপোড়েন চলছে। স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্পিকারের বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে প্রশাসন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, “সাবেক স্পিকার সম্পর্কে কোনো অফিসিয়াল তথ্য নেই। যতদূর জানি, তিনি ঢাকাতেই আছেন—সম্ভবত ভাইয়ের বাসায়। আবার কেউ কেউ বলছেন, তিনি স্থলপথে সীমান্ত পেরিয়ে গেছেন। আমরা এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক নির্দেশ পাইনি।”
রাজনৈতিক শাখার আরেক কর্মকর্তা বলেন, “শিরীন শারমিনের বিষয়টি নীতিনির্ধারক পর্যায়ের। আদালতের পরোয়ানা বা নির্দেশনা এলে আমরা অবশ্যই তা বাস্তবায়ন করব।”
সরকারের দুই গোয়েন্দা সংস্থা ও একটি তদন্ত সংস্থার প্রধানও স্বীকার করেছেন—শিরীন শারমিন বর্তমানে ঢাকায়, ভাইয়ের সুরক্ষিত বাসায় অবস্থান করছেন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে নিয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশ এখনো আসেনি।
বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, চলতি বছরের শুরুতে তিনি রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় ছিলেন। একবার তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা হলেও রহস্যজনক কারণে তা স্থগিত হয়। এরপর তিনি দ্রুত অবস্থান পরিবর্তন করেন। হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে যিনি ছিলেন ‘পুতুল সংসদের’ প্রতীক, সেই শিরীন শারমিন তখন আত্মগোপনে যান।
প্রায় ছয় মাস আগে তিনি রাজধানীর এক সুরক্ষিত এলাকায় নিকটাত্মীয়ের বাসায় গিয়ে ওঠেন। সেখান থেকেই তিনি নতুন সাধারণ ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। পাসপোর্ট অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তার সহযোগিতায় আঙুলের ছাপ ও আইরিস স্ক্যানও সম্পন্ন হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশন শাখা নিশ্চিত করেছে—তিনি আত্মগোপনেই ছিলেন যখন নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। যদিও আবেদনপত্রে ধানমন্ডির একটি ঠিকানা দেওয়া হয়েছিল, গোয়েন্দা সূত্র বলছে, তিনি সেখানে নেই। ফলে তার বর্তমান অবস্থান এখনও রহস্যাবৃত।


