সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাঁজা বিক্রি করতে নিষেধ করায় খুন হন ছাত্রদল নেতা সাম্য, সাতজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার ঘটনায় সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উদ্যানে গাঁজা বিক্রিতে বাধা দেওয়ায় সাম্যকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।

ডিবির পরিদর্শক আখতার মোর্শেদ বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) সন্ধ্যায় ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চার্জশিট জমা দেন। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী এবং এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক সাম্য হত্যার ঘটনায় সাতজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তদন্তে চারজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।

অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন— মেহেদী হাসান, মো. রাব্বি ওরফে কবুতর রাব্বি, মো. রিপন ওরফে আকাশ, নাহিদ হাসান পাপেল, মো. হৃদয় ইসলাম, মো. হারুন অর রশিদ সোহাগ ওরফে লম্বু সোহাগ এবং মো. রবিন। তদন্ত কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, সবাই চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী।
অব্যাহতির সুপারিশ পাওয়া চারজন হলেন— তামিম হাওলাদার, সম্রাট মল্লিক, পলাশ সরদার ও সুজন সরকার।

গত ১৩ মে রাত ১১টার দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত হন সাম্য (২৫)। পরের রাত ১২টার দিকে বন্ধুরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পরদিন সকালে নিহতের বড় ভাই শরীফুল ইসলাম শাহবাগ থানায় ১০ থেকে ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন।

তদন্তে উঠে আসে, মেহেদী, রিপন, কবুতর রাব্বি, পাপেল, হৃদয়, রবিন ও সোহাগ— এরা উদ্যানে গাঁজা বিক্রিতে জড়িত। মেহেদী ছিলেন তাদের দলনেতা। প্রত্যেকে মেহেদীর কাছ থেকে গাঁজা নিয়ে মন্দির গেট এলাকার আশেপাশে খুচরা বিক্রি করত এবং বিক্রির টাকা শেষে তার কাছে জমা দিত।

ঘটনার আগের দিন রিপন ও রাব্বি দাবি করে, গাঁজা বিক্রির টাকা এলাকার মাস্তানদের চাপে দিতে পারছে না। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মেহেদী তাদের প্রতিরোধের নির্দেশ দেন এবং সুইচ গিয়ার (চাকু) ও ইলেকট্রিক ট্রেজারগান সরবরাহ করেন।

মেহেদী ও তার সহযোগীরা যখন উদ্যানে গাঁজা বিক্রি করছিল, তখন সাম্য ও তার বন্ধুরা তাদের বাধা দেয়। এ থেকেই শত্রুতার সূত্রপাত।

১৩ মে রাতে মুক্ত মঞ্চের কাছে কবুতর রাব্বি ইলেকট্রিক ট্রেজারগান হাতে গাঁজা বিক্রি করছিল। সাম্য মোটরসাইকেলে তার দুই বন্ধুসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে রাব্বিকে থামতে বলেন। রাব্বি পালিয়ে গেলে সাম্য তাকে ধাওয়া করে ধরে ফেলে এবং ট্রেজারগানটি নেওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় সাম্য রাব্বিকে চড়-থাপ্পড় দিলে তার চিৎকারে পাপেল, রিপন, মেহেদী, সোহাগ, হৃদয় ও রবিন ঘটনাস্থলে আসে এবং হাতাহাতি শুরু হয়।

ধস্তাধস্তির সময় এক পথচারীর মোটরসাইকেল পড়ে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাশের লোকজন তাদের শান্ত হতে বলে। কিন্তু মেহেদী উল্টো সেই ব্যক্তিকেই (পলাশ সরদার) ঘুষি মেরে অজ্ঞান করে দেয়। এরপর সম্রাট মল্লিক এগিয়ে এলে তাকেও ছুরিকাঘাত করা হয়।

পরবর্তীতে মেহেদী ও তার সহযোগীরা সাম্যর ওপর আক্রমণ করে— মেহেদী তার বুকের ওপর ঘুষি মারে এবং কবুতর রাব্বি সুইচ গিয়ার দিয়ে তার ডান উরুতে ছুরিকাঘাত করে। এতে সাম্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

চিৎকার শুনে মন্দিরের ভেতর ও আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে আসামিরা পালিয়ে যায়। রিপন তার মোটরসাইকেলে কবুতর রাব্বিকে নিয়ে মেহেদীর আস্তানায় লুকিয়ে পড়ে।

চার্জশিটে আরও বলা হয়, ঘটনার সময় সুজন সরকার ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তিনি ওই রাতে ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় খাওয়া শেষে ঘুরতে গিয়ে আহতদের দেখতে পান এবং পরে ফেসবুক লাইভে সাম্যর মৃত্যুর বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করেন। তদন্তে প্রমাণিত হয়, তিনি ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।

তামিম হাওলাদার, সম্রাট মল্লিক ও পলাশ সরদারও ঘটনাস্থলে পথচারী ছিলেন। তারা মারামারি থামানোর চেষ্টা করলে আহত হন। তদন্তে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি।

পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শী নাসির ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে খবর দিলে শাহবাগ থানার পুলিশ দ্রুত উপস্থিত হয়ে আসামিদের গ্রেপ্তারের অভিযান চালায়। তদন্তে জানা যায়, তামিম, সম্রাট ও পলাশ পেশায় সাধারণ শ্রমজীবী; কারও সঙ্গে ছাত্রদল নেতা সাম্য কিংবা আসামিদের পূর্ব পরিচয় ছিল না।

তদন্ত শেষে ডিবি পুলিশ নিশ্চিত করেছে, তারা নির্দোষ— বরং সাম্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেরাই আহত হয়েছিলেন। তাই তাদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *