এনসিপি’র সঙ্গে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের দূরত্ব বাড়ছে, নির্বাচনকে ঘিরে জটিলতা

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া (Asif Mahmud Sojib Bhuiyan) এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি (National Citizens’ Party – NCP)–র মধ্যে সম্পর্কের টানাপড়েন নতুন মাত্রা পেয়েছে। মূল সংকট শুরু হয় আসিফের উপদেষ্টা পদ ছাড়ার পরিকল্পনা এবং এর বিনিময়ে দলের ‘মুখ্য সমন্বয়ক’ পদ চাওয়ার মাধ্যমে। দলীয় নেতারা তাকে এই পদ দিতে অনিচ্ছুক, কারণ বর্তমানে পদটি দখলে আছে দলটির সাবেক আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী (Nasiruddin Patwari)-র, যিনি বর্তমানে এনসিপির নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান ও কৌশলগত নেতৃত্বে রয়েছেন।

আসিফের অনুসারীরা–বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলন, জাতীয় ছাত্রশক্তি ও জাতীয় যুবশক্তির নেতাকর্মীরা চান তাকে ‘মুখ্য সমন্বয়ক’ করা হোক। কিন্তু সেই দাবি পূরণ না হওয়ায় আসিফ সক্রিয় করেছেন দীর্ঘদিন স্থগিত থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের কমিটি, যার ফলে এনসিপি ও জাতীয় ছাত্রশক্তিতে অস্বস্তি ছড়িয়েছে।

এছাড়া গুঞ্জন রয়েছে, আসিফের নির্দেশনায় গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক আহ্বায়ক এবং ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে ৯ দফা ঘোষক আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে একটি নতুন সংগঠনেরও আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে। বর্তমানে আব্দুল কাদের কোনও সংগঠনের সাথেই যুক্ত নন। এনসিপির ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, দলকে এতদিন যেভাবে সহায়তা দিতেন আসিফ, তা এখন আর করছেন না। অনেকে একে সরাসরি ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে দেখছেন।

এদিকে, নির্বাচনী মাঠে নামার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন আসিফ মাহমুদ। তিনি সম্প্রতি ঢাকা-১০ আসনের ধানমণ্ডি এলাকায় ভোটার হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই আসন থেকেই নির্বাচন করতে চান তিনি। যদিও পূর্বে গুঞ্জন ছিল তিনি কুমিল্লা-৩ আসনে নির্বাচন করবেন, তবে সেখানে বিএনপি ইতোমধ্যে জনপ্রিয় নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ (Kazi Shah Mofazzal Hossain Kaykobad)-কে প্রার্থী করায় আসিফ তার কৌশল পরিবর্তন করেছেন। তার ঘনিষ্ঠরা জানিয়েছেন, শিগগিরই তিনি উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করে প্রচারণা শুরু করবেন।

উল্লেখ্য, ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের প্রতিনিধি হিসেবে নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন। পরে, নাহিদের নেতৃত্বে গঠিত হয় এনসিপি। দলের গঠনে এবং পরবর্তী বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে আসিফ পর্দার আড়াল থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখন তিনিই দলের অন্যতম বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু।

দলীয় পদ না পেয়ে দ্বন্দ্ব বাড়তেই থাকে। ২৪ অক্টোবর হঠাৎ ছড়িয়ে পড়ে, নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী পদত্যাগ করছেন। পরবর্তীতে এনসিপি পক্ষ থেকে একটি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নাসির এখনো দলের সঙ্গেই আছেন এবং গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, পদ নিয়ে অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন এখনো অমীমাংসিত।

অন্যদিকে, গত শুক্রবার দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সাধারণ সভায় নির্বাচন নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়। আলোচনা হয়, দলটি এককভাবে নির্বাচন করবে না জোটবদ্ধ হয়ে। সাধারণ সভায় অধিকাংশ সদস্য এককভাবে নির্বাচনের পক্ষে মত দেন। তাদের মতে, জোটগত নির্বাচনে আপাতত কিছু আসন পাওয়া সম্ভব হলেও দীর্ঘমেয়াদে তৃতীয় শক্তি হয়ে উঠার পথে তা বাধা হতে পারে।

বিএনপি ও জামায়াতের সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনায় নেতারা নানা সংশয় প্রকাশ করেন। বিএনপির সঙ্গে জোট করলে মাঠপর্যায়ে সমন্বয় নিয়ে সমস্যা হতে পারে এবং বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে বলে মত দিয়েছেন অনেকে। জামায়াতের সঙ্গে জোটে গেলে যদিও বেশি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্ভব, তবুও তাদের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান ও ধর্মীয় রাজনীতির কারণে আপত্তি রয়ে গেছে। এনসিপির একটি অংশ মনে করে, জামায়াতের সঙ্গে গেলে তৃণমূল নেতাকর্মীরা একযোগে কাজ করবে, তবে আরেক পক্ষ এই জোটকে রাজনীতিতে বাধা হিসেবে দেখছে।

ডাকসু নির্বাচনে পরাজয়ের পর ছাত্রসংগঠন বাগছাস যেভাবে রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে, তেমনি এনসিপিও সংসদে না গেলে একই পরিণতি হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। জোটগত নির্বাচন নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি; সাধারণ সভা থেকে জানানো হয়, ভবিষ্যতে জোট করলে অবশ্যই সাধারণ সভার অনুমোদন নিতে হবে। এককভাবে শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্ত নিলে, দল ভাঙনের ঝুঁকিও থেকে যায়।

এনসিপির এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “জোটে গেলে আপাতত লাভ হবে, না গেলে দীর্ঘমেয়াদে। কিন্তু এককভাবে গিয়ে যদি ডাকসুর মতো ভরাডুবি হয়, তবে দলটির ভবিষ্যৎ রাজনীতিই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।” আসিফ মাহমুদের সঙ্গে দূরত্ব নিয়ে তিনি বলেন, “এটা সত্য যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। এখন তারই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—তিনি কি অভ্যুত্থানের শক্তির সঙ্গে থাকবেন, না কি ক্ষমতার সঙ্গে?” তথ্যসূত্র : মানবজমিন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *