বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন ৮ দল ৫ দফা দাবিতে আগামী ১১ নভেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে। সেই সাথে এই মহাসমাবেশ থেকে আরও কঠোর কর্মসূচি দেওয়ারও হুমকি দিয়েছে। তারা বলছে ওই দিন রাজধানী ঢাকার চিত্র পাল্টে যাবে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায় কবে হবে তা জানানো হবে আগামী ১৩ নভেম্বর। তাই ওই দিন রাজপথে থাকার ঘোষণা দিয়েছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন এডিশনে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার মামলায় সাজা ঘোষণার দিন জানাবে। ট্রাইবুনালের বিচারপতি গোলাম মোর্তুজা মজুমদার গত মাসে এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন। ওই দিন (সোমবার) থেকে রাস্তায় নামছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছে ‘১৩ তারিখে আমরা সবাই ঢাকা যাব’ এই লিখে। জামায়াত এবং আওয়ামী লীগের এই কাছাকাছি সময়ে এমন কর্মসূচি নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকে এই কর্মসূচিকে ঘিরে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে চাচ্ছেন। তারা বলছেন, দেশের মানুষ যখন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের অপেক্ষায় দিনগুনছে, ঠিক তখন জামায়াতসহ কয়েকটি দল নিজেদের স্বার্থে রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের এই আন্দোলন আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই করছে। অনেকে বলছেন, আওয়ামী লীগের সাথে গোপন আঁতাত করেই হয়তো জামায়াত ও তার মিত্ররা এ আন্দোলন শুরু করেছে। কেননা জামায়াতের সাথে বর্তমানে যে ৮টি দল যুগপৎ আন্দোলন করছে তাদের মধ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এ দলটি এর আগে আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসাবেও কাজ করেছে। অন্যদিকে এ দলটির সাথে দিল্লির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বিষয়টিও রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত। তাই রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সব মিলিয়ে আসছে ১১ নভেম্বর জামায়াতের নেতৃত্বে রাজধানীতে মহাসমাবেশ এবং ১৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগের ঢাকা যাওয়ার কর্মসূচির মধ্যে একটি যোগসূত্র থাকতেও পারে। দেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আগামী নির্বাচন বানচালের এটি যৌথ পরিকল্পনা কি না সেটাও ভেবে দেখতে হবে।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. জাহেদ উর রহমান বলেন, জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে ৮ দল যে সব দাবিতে আন্দোলন করছে সেগুলোর এই মুহূর্তে যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ করে এ দলটি পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের যে দাবি করছে তা ভারতীয় এজেন্ডা এটি আমি বহুবার বলেছি। বর্তমানে নির্বাচনের প্রাক্কালে তারা রাজপথ উত্তপ্ত করার যে আন্দোলন করছে সেটাও নির্বাচন বানচালেরই পরিকল্পনা বলে মনে হয়।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। এ নির্বাচনকে বানচাল করতে দেশে ভয়াবহ নাশকতা ঘটতে পারে এমন আশঙ্কার কথা গোয়েন্দাদের তরফ থেকে গত মাসে সরকারকে জানানো হয়েছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয় দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, স্থাপনা, কেপিআই এলাকা, গার্মেন্টস শিল্প এমনকি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে টার্গেট করে নাশকতার আশঙ্কা রয়েছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গতমাসে চট্টগ্রামের ইপিজেড ও রাজধানীর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে যে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে তাতে নাশকতার আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। ফলে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ব্যাপকভাবে নাশকতাসহ বিভিন্ন ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মুখে বাংলাদেশ পড়তে পারে। এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দেশি-বিদেশি চক্রান্ত চলছে বলেও গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে। আর এই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতেই গত ২৯ অক্টোবর ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যমুনায় অনুষ্ঠিত সমন্বয় সভায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা হবে। নির্বাচন বানচালের জন্য ভেতর থেকে, বাইরে থেকে অনেক শক্তি কাজ করবে। ছোটখাটো নয়, বড় শক্তি নিয়ে বানচালের চেষ্টা করবে। হঠাৎ করে আক্রমণ চলে আসতে পারে। এই নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে।
এই আশঙ্কারই বহিঃপ্রকাশ গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রামে দেখা গেল। ওইদিন চট্টগ্রামে নির্বাচনী জনসংযোগের সময় নগর বিএনপির আহ্বায়ক ও আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনের দলটির মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ সময় ‘গণসংযোগে অংশ নেওয়া’ সরোয়ার হোসেন ওরফে বাবলা (৪৩) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন আরও কয়েকজন। চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে নগর বিএনপির আহ্বায়কের গণসংযোগে ‘পরিকল্পিত’ হামলাকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার পাঁয়তারা হিসেবে দেখছেন রাজনৈতিক নেতারা।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রাপ্ত মো. এরশাদ উল্লাহর ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর পতনের পর দুষ্কৃতকারীরা আবারও দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টিসহ নৈরাজ্যের মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়েছে।
আগামী নির্বাচন বানচালের দেশি-বিদেশি এরকম ষড়যন্ত্রের বিষয় যখন সরকারকেও শঙ্কিত করছে তখন জামায়াত এবং আওয়ামী লীগের এমন তৎপরতা সে শঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত আছে। এ দলটির নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পারছে না। তাই তারা যে কোন দলের আন্দোলন কর্মসূচিতে মিশে গিয়ে বড় ধরনের নাশকতা সৃষ্টির পরিকল্পনা করছে। নির্বাচনের আগে আগে জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নাশকতা সৃষ্টির সুযোগ করে দিচ্ছে কি না সে প্রশ্নও অনেকের মনে।


