জাতীয় নাগরিক পার্টি—এনসিপি (National Citizen Party)—এর অভ্যন্তরে নতুন করে দানা বাঁধছে গৃহদাহ। ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং মাহফুজ আলমকে ঘিরে দলটির ভেতরে তৈরি হয়েছে দুইটি শক্তিশালী গ্রুপ, যাদের দ্বন্দ্ব এখন দৃশ্যমানভাবে ফেসবুক পোস্ট ও পদত্যাগের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে।
দলের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, এনসিপি গঠনের সূচনালগ্ন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন এই দুই ছাত্র উপদেষ্টা। তাঁদের প্রভাব ও পদবিন্যাসকে ঘিরে এখন দলে গভীর বিভাজন। দল ছাড়ার পর আহ্বায়কের দায়িত্বে থাকা আরেক ছাত্র উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সরকারের ভূমিকা এ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
এনসিপির হয়ে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার লক্ষ্যে আসিফ মাহমুদ গত অক্টোবরে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে একটি প্রস্তাব দেন, যাতে তিনি দলের মুখ্য সমন্বয়কের দায়িত্ব চান। তবে শুরু থেকেই এই পদে কাজ করে আসা এবং মাহফুজ আলমের অনুসারী নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এ প্রস্তাব মেনে নিতে পারেননি। যদিও শীর্ষ নেতারা সরাসরি বিরোধিতা করেননি, তাদের নীরব সম্মতির প্রতিক্রিয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে নাসীরুদ্দীন পদত্যাগপত্র জমা দেন।
দলীয় হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে দেওয়া এক বার্তায় তিনি লিখেছেন, “কমরেডস, আই রিজাইনড ফর্ম পোর্টফোলিও এজ চিফ কো-অর্ডিনেটর, অলসো এজ পলিটিক্যাল কাউন্সিল অ্যান্ড এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল মেম্বার। আই উইল স্টে এজ আ লয়াল পার্টি মেম্বার…”—এই বক্তব্যে তিনি দলের প্রতি আনুগত্য রাখার কথা জানালেও সংগঠনের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান।
ঘটনার প্রায় দুই সপ্তাহ পর বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক আর সোশ্যাল মিডিয়ায় নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর পদত্যাগের খবর প্রকাশিত হলে নড়ে চড়ে বসেন দলের নেতার। এসময় দল আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, নাসীরুদ্দীন এখনো দলের সঙ্গেই রয়েছেন। তিনি নিজেও গণমাধ্যমের সামনে এসে এই তথ্য নিশ্চিত করেন।
অন্যদিকে, মুখ্য সমন্বয়কের পদ না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ আসিফ মাহমুদের অনুসারীরাও দলীয় কর্মকাণ্ড থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। তিনি পুনরায় সক্রিয় করেছেন পূর্বে স্থগিত হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কমিটি এবং জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনায় এনসিপিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বলেন, “নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের রূপরেখা কী? আমিও রাজনীতি করব, আমাকেও খুঁজতে হবে আসলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কী?”
এই মন্তব্য এবং সংগঠনের পুনরায় সক্রিয়তা এনসিপি ও তাদের ছাত্র সংগঠন জাতীয় ছাত্রশক্তি-র মধ্যে অস্বস্তি তৈরি করেছে। গুঞ্জন উঠেছে, আসিফের ঘনিষ্ঠ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সাবেক আহ্বায়ক এবং গণ অভ্যুত্থানের ৯ দফা ঘোষক আবদুল কাদের নেতৃত্বে নতুন একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটতে যাচ্ছে।
এর মাঝেই ফেসবুকে দুটি বিতর্কিত পোস্ট করে আবারো উত্তেজনা ছড়িয়েছেন আবদুল কাদের। তিনি এনসিপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগির জন্য ধরনা দেওয়ার অভিযোগ আনেন। এই বিতর্কের সূচনা হয় নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর দুই লাইনের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসকে ঘিরে, যেখানে তিনি লেখেন, “বন্ধু, তোমার লাল টুকটুকে স্বপ্ন আর পতাকা একটা সিটের বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়ো না।”
দলীয় সূত্র জানায়, এই স্ট্যাটাসের ইঙ্গিত ছিল আসিফ মাহমুদের দিকে। কারণ, গুঞ্জন রয়েছে তিনি এনসিপি থেকে দূরত্ব তৈরি করে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-১০ আসনে নির্বাচন করতে পারেন।
আসিফপন্থী আবদুল কাদের এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় আরও জোরালো অভিযোগ তোলেন। তিনি বলেন, “একটা দলের নেতারা দিনের বেলায় বিএনপিকে নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে; আর রাতের বেলায় সালাহউদ্দিন সাহেবের বাসায় তিনবার, মির্জা ফখরুলের বাসায় একবার ধরনা দিয়েছে ২০টি আসনের জন্য!” এই বক্তব্যে তিনি এনসিপির বর্তমান নেতৃত্বের ‘দ্বিমুখী নীতি’কে তুলে ধরেন।
তিনি আরও বলেন, “আসন ভাগাভাগির কৌশল হিসেবে মিডিয়ায় গালিগালাজ করে বেড়ান; অথচ রাতে আবার বিএনপি নেতার বাসায় বসে থাকেন, তবু আসন মেলে না!”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এনসিপির এক যুগ্ম সদস্যসচিব বলেন, “আসিফ মাহমুদ ও মাহফুজ আলমের গ্রুপিংয়ের কারণে বারবার দলের রাজনৈতিক লক্ষ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”
দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব এ প্রসঙ্গে বলেন, “বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতার যেসব অভিযোগ উঠছে তা ভিত্তিহীন। কারও মনগড়া ব্যাখ্যা দিয়ে চলমান আলোচনা বা আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগকে বিকৃত করে দেখানোর চেষ্টা চলছে। এনসিপি নিজস্ব শক্তি ও কৌশলে এককভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়।”
এনসিপির এই গ্রুপিং ও পদবিভাজনের দ্বন্দ্ব দলটির সাংগঠনিক কাঠামো এবং আসন্ন নির্বাচনী প্রস্তুতিকে যে কতটা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে, তা এখন স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।


