মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ মূল্যায়নে কিছু উন্নতি হলেও ২২ সূচকের ১৬টিতে পিছিয়ে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সহায়তা তদারককারী সংস্থা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (Millennium Challenge Corporation–MCC) তাদের নতুন মূল্যায়নে জানিয়েছে—কার্যকর মোট ২২টি সূচকের মধ্যে ১৬টিতেই রেড জোনে রয়েছে বাংলাদেশ। শুক্রবার এমসিসির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এই স্কোরকার্ডে সরকার পরিচালনার কার্যকারিতা থেকে শুরু করে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, জবাবদিহিতা, তথ্যের স্বাধীনতা—প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সূচকেই দেশের অবস্থান পিছিয়ে রয়েছে।

প্রতিবেদন বলছে, রেড জোনে থাকা সূচকগুলোর মধ্যে রয়েছে—গভর্নমেন্ট ইফেকটিভনেস, কন্ট্রোল অব করাপশন, গভর্নমেন্ট অ্যাকাউন্টিবিলিটি, নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকারিতা, বাণিজ্য নীতিমালা, তথ্যের স্বাধীনতা, অর্থনীতিতে নারী-পুরুষ সমতা, সরকারি স্বাস্থ্য ব্যয়, প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যয়, প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ, আইনের শাসন ও শ্রমশক্তির উন্নয়ন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঋণ প্রাপ্তি, কর্মসংস্থানের সুযোগ, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশগম্যতা, মেয়েদের মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্তির হার এবং শিশুস্বাস্থ্য।

অপরদিকে তুলনামূলক ভালো অবস্থানে থাকা গ্রিন জোনের সূচকগুলো হলো—মূল্যস্ফীতি, সম্পদ ও ভূমি অধিকার, ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়া, বাজার প্রতিযোগিতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগসংক্রান্ত সূচক। সব মিলিয়ে ২২টির মধ্যে মাত্র ৬টি সূচকে বাংলাদেশ গ্রিন জোনে আছে।

এমসিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ভারতের ৭টি, পাকিস্তানের ১২টি, ভুটানের ৮টি, নেপালের ২টি এবং শ্রীলংকার ৬টি সূচক রেড জোনে রয়েছে। তবে বাংলাদেশের অবস্থান প্রতিবছরই অবনমনের ধারায় রয়েছে—২০২৪ সালে ২০টির মধ্যে ১৭টি, ২০২৩ সালে ১৭টি, ২০২২ সালে ১৬টি, ২০২১ সালে ১৩টি, ২০২০ সালে ১২টি, ২০১৯ সালে ১১টি এবং ২০১৮ সালে রেড জোনে ছিল ৭টি সূচক।

শনিবার এই মূল্যায়ন নিয়ে মত দেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান (Dr. Iftekharuzzaman)। তিনি যুগান্তরকে বলেন, “দুর্নীতিসহ যেসব বিষয়ে আমরা লাল তালিকায় আছি, সেগুলো ৫৪ বছরের জঞ্জাল। গত ১৬ বছরের শাসনে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ফলে মাত্র এক-দেড় বছরের অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে স্কোর উন্নতি আশা করা যৌক্তিক নয়।” তাঁর মতে, বিভিন্ন কমিশন ও সংস্কার কমিটির সুপারিশ গ্রহণ ইতিবাচক হলেও অধ্যাদেশ বাস্তবায়নে দুর্বলতা ও পিছিয়ে আসার প্রবণতা স্কোরে প্রভাব ফেলেছে।

এদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) জানিয়েছে, এই দুর্বল স্কোরের কারণে এবারও বাংলাদেশের জন্য খোলা হচ্ছে না মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ড (এমসিএফ)–এর বড় অঙ্কের অনুদানের দরজা। স্কোর উন্নত দেশগুলোই এই ফান্ডে অন্তর্ভুক্ত হয়, আর কয়েক বছরের প্রচেষ্টার পর এখন ইআরডির ভেতরেও নেমে এসেছে হতাশা। বিশেষজ্ঞদের মতে, অনুদান না পাওয়া এক বিষয়; কিন্তু এর সঙ্গে দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিও জড়িত, তাই বসে থাকার সুযোগ নেই।

ইআরডির সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী শফিকুল আযম (Kazi Shofiqul Azam) মনে করেন, “ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন সহায়তা নীতি অনুদান পাওয়া কঠিন করেছে। কিন্তু স্কোর শুধু অর্থ নয়, দেশের ভাবমূর্তির বিষয়। আর এই মূল্যায়নে রাজনীতির প্রভাবও আছে। স্কোর উন্নতিতে ইআরডির করণীয় কম; পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হতে হবে, আর সবচেয়ে জরুরি সুশাসনের ঘাটতি পূরণ।”

সূত্র জানায়, ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ ফান্ড গঠন করে এবং তা বাস্তবায়নের জন্যই সক্রিয় হয় এমসিসি। ‘থ্রেশহোল্ড কান্ট্রি’ হিসেবে ১০ থেকে ৪০ কোটি ডলার এবং ‘কমপ্যাক্ট’ হিসেবে ৫০ কোটি ডলার বা তার বেশি অনুদান পায় যোগ্য দেশগুলো। প্রথমদিকে ১৭টি সূচকে মূল্যায়ন হলেও ২০১২ সালে তা বাড়িয়ে ২০টি করা হয়; ২০২৬ সালের স্কোরকার্ডে সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২টি।

আরও জানা যায়, ২০১২ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সফরকালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এমসিএফ-এ যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। পরে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন পার্টনারশিপ ডায়ালগ–কেন্দ্রিক বৈঠকে, যেখানে স্কোরকার্ড–সম্পর্কিত বিষয়ও আলোচনায় উঠে আসে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *