হাসিনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে বড় বাধা ভারত: সিএনএনের প্রতিবেদন

একদা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রতীক, বিপ্লবী নেতার কন্যা, দীর্ঘ একচ্ছত্র শাসনের পর বিতাড়িত—শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina)-র রাজনৈতিক যাত্রা যেন এক অনন্য ট্র্যাজেডির নাম। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এখন ভারতে নির্বাসিত, যেখানে তার বিরুদ্ধে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর নিয়ে জটিল অচলাবস্থায় পড়েছে দুই প্রতিবেশী দেশ।

২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান দমনে সহিংসতার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হন হাসিনা। অনুপস্থিতিতেই তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। নয়াদিল্লি তাকে হস্তান্তর করলে, যে কোনো সময় রায় কার্যকর হতে পারে। তবে ভারত এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছায়নি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোবাশ্বার হাসান বলেন, “গণরোষ থেকে বাঁচতেই তাকে পালাতে হয়েছিল। এখন তিনি দাবি করছেন, সব অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।” একদিকে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা, অন্যদিকে ভারতের কূটনৈতিক সমীকরণ—এই দুইয়ের মাঝখানে আটকে আছেন হাসিনা।

শেখ হাসিনার শাসনের ইতিহাস যেমন উন্নয়নগাথা, তেমনি ক্ষমতাকেন্দ্রিক দমন-পীড়নের বিতর্ক। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর তিনি ছয় বছর বিদেশে নির্বাসিত ছিলেন। সেই স্মৃতি যেন আবার ফিরে এসেছে—এবার আরেকটি নির্বাসনের রূপে।

১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করেন তিনি। ২০০৮ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে কঠোর প্রশাসনিক মনোভাবে রূপান্তরিত হন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ভারতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক—সবই তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, কিন্তু একইসঙ্গে বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং নির্বাচন নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে তার সরকার।

শেষ পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলনের জেরে জাতীয় বিক্ষোভ শুরু হয়। জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, সহিংস দমন অভিযানে প্রাণ হারায় অন্তত ১,৪০০ মানুষ। আন্দোলন দমাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তার সরকার পড়ে যায়। ২০২৪ সালের আগস্টে তিনি ভারতে পালিয়ে যান।

রায়ের পর আদালতে করতালির ঝড় ওঠে। এক শহিদ ছাত্রের বাবা আবদুর রব বলেন, “এই রায় কিছুটা শান্তি দিলেও হাসিনার ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত শান্তি মিলবে না।”

ভারত নিজেও মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে, তবে হাসিনার মতো রাজনৈতিক মামলায় তাদের অবস্থান জটিল। নয়াদিল্লির সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুণায়েত মনে করেন, “এই রায় রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ রয়েছে। ভারতের আইনেও রাজনৈতিক অপরাধে প্রত্যর্পণ না করার বিধান রয়েছে।”

তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় (Sajeeb Wazed Joy) জানান, “এই সংকটে ভারতই আমার মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে।”

এদিকে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রায়ের দিনই ভারতকে হাসিনাকে ‘বিলম্ব না করে’ হস্তান্তরের আহ্বান জানিয়েছে।

এ রায়ের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা তীব্র হয়েছে। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় এবং নেতৃত্ব ভেঙে পড়ায় অন্তর্বর্তী সরকার কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। যদিও প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর সামনে সম্ভাবনার জানালা খুলেছে, বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজন এত গভীর যে সহাবস্থানের পথ এখনও সুদূর।

মোবাশ্বার হাসান বলেন, “আওয়ামী লীগ হয়তো আবার ফেরার চেষ্টা করবে, তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নয়।”

তবু প্রশ্ন থেকে যায়—শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে কি এক বিভক্ত অধ্যায়ের ইতি ঘটেছে? নাকি বাংলাদেশ প্রবেশ করেছে এক অনিশ্চিত, অস্থির ভবিষ্যতের পথে?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *