রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় আটক আয়েশা আক্তার আগেও মোহাম্মদপুর এলাকায় গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে চুরির ঘটনা ঘটিয়েছিল। যে ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং আটকও হয়েছিল সে। সেই জিডি, জিডির সূত্রে পাওয়া একটি মোবাইল ফোন নম্বর এবং আসামি আয়েশার গলায় পোড়া দাগের সূত্র ধরেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মা-মেয়ে হত্যার আলোচিত ঘটনার তদন্তে নেমে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা প্রথমে কোনো কূলকিনারা করতে পারছিলেন না। পরে পুরোনো অভিযোগই শেষ পর্যন্ত মা-মেয়ে হত্যার রহস্য উন্মোচনের সূত্র হয়ে দাঁড়ায়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করে এসব তথ্য জানান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম।
মোহাম্মদপুরে নিজ বাসায় লায়লা ফিরোজ আফরোজা (৪৮) ও তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫) হত্যার ঘটনায় গৃহকর্মী আয়েশা এবং তার স্বামী রাব্বিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল আদালত আয়েশার ছয় দিন এবং রাব্বির তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
তদন্ত কর্মকর্তারা জানান, হত্যাকাণ্ডের পর আয়েশার কোনো ছবি, এনআইডি, ফোন নম্বর বা বাসায় সংরক্ষিত পরিচয় না থাকায় তাকে শনাক্ত করা ছিল কঠিন। বোরকা পরে বাসায় প্রবেশ এবং হত্যার পর স্কুলড্রেস পরে বের হওয়ার সিসিটিভি ফুটেজেও তার চেহারা ধরা পড়েনি স্পষ্টভাবে। কোনো ডিজিটাল ক্লু মিলছিল না তদন্তকারীদের হাতে।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম গতকালের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ঘটনার কোনো প্রযুক্তিগত তথ্য না পেয়ে পুলিশ ম্যানুয়ালি গত এক বছরে গৃহকর্মীদের মাধ্যমে সংঘটিত চুরির অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে শুরু করে। নিহত আফরোজার স্বামীর বর্ণনার ভিত্তিতে তদন্তকারীরা বিশেষ দৃষ্টি দেন গলায় পোড়া দাগ, জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় বসবাস এবং পূর্বে গৃহকর্মী সাজিয়ে চুরির অভিযোগের বিষয়ে।’
তিনি বলেন, ‘হুমায়ুন রোড এলাকার একটি ভুক্তভোগী পরিবারের পুরোনো অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গিয়ে পুলিশের হাতে আসে একটি মোবাইল ফোন নম্বর। কলরেকর্ড বিশ্লেষণে নম্বরটির অবস্থান ধরে তদন্তকারীরা ঢাকার উপকণ্ঠের হেমায়েতপুরে পৌঁছান। সেখানেই জানা যায় ফোনটি ব্যবহার করত রাব্বি নামের এক ব্যক্তি, আর তার স্ত্রীই আয়েশা। দুজন আগে থাকত মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প এলাকায়। হেমায়েতপুরে তাদের বাসা তালাবদ্ধ পাওয়া গেলে রাব্বির স্বজনদের কাছ থেকে আরও তথ্য নিয়ে ঢাকার আশুলিয়া, বরিশাল, পটুয়াখালীসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায় পুলিশ। শেষ পর্যন্ত ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার চরকায়া গ্রামে এক আত্মীয়ের বাসা থেকে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় আয়েশার কাছ থেকে চুরি করা একটি ল্যাপটপও উদ্ধার করা হয়।’
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আয়েশা মা-মেয়েকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ডিএমপি কর্মকর্তারা জানান, কাজে যোগ দেওয়ার দ্বিতীয় দিন বাসা থেকে ২ হাজার টাকা চুরি করে আয়েশা। তৃতীয় দিন টাকা নিয়ে গৃহকর্ত্রীর সঙ্গে তর্কাতর্কি হয়। চতুর্থ দিন সে একটি সুইচগিয়ার চাকু লুকিয়ে নিয়ে বাসাটিতে যায়। আবারও তর্ক হলে আফরোজা স্বামীর মোবাইল ফোনে কল করতে গেলে পেছন থেকে ছুরি মারে আয়েশা। ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে এলোপাতাড়ি আঘাতে মৃত্যু হয় আফরোজার।
মায়ের চিৎকারে ঘুম থেকে ওঠা নাফিসা ছুটে এলে তাকেও ছুরিকাঘাত করে আয়েশা। প্রাণ বাঁচাতে নাফিসা ইন্টারকমে কল করতে চাইলে ফোনের তার ছিঁড়ে ফেলে আয়েশা।
নজরুল ইসলাম জানান, হত্যার পর রক্তমাখা পোশাক বদলে নাফিসার স্কুল ড্রেস পরে বাসা ছাড়ে আয়েশা। ব্যাকপ্যাকে ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন নিয়ে যায় এবং পরে মানিকগঞ্জের সিংগাইর ব্রিজ থেকে ফোন ও পোশাক ভর্তি ব্যাগ নদীতে ফেলে দেয়। পালানোর পুরো প্রক্রিয়ায় সহায়তা করে তার স্বামী রাব্বি।
এর আগে গত সোমবার মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে আফরোজা ও তার মেয়ের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিন রাতেই নিহতের স্বামী স্কুলশিক্ষক আ জ ম আজিজুল ইসলাম গৃহকর্মী আয়েশাকে একমাত্র আসামি করে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন।


