ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের ফিলিপ স্নাল—নামটি এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সবচেয়ে আলোচিত। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর চালানো হামলার পর থেকেই তাকে ধরতে হন্যে হয়ে খুঁজছে প্রশাসন। হামলাকারী ফয়সাল-আলমগীর সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালিয়েছে নাকি এখনও দেশের ভেতরেই রয়েছে—এই প্রশ্নের উত্তর মিলতে পারে একমাত্র ফিলিপ স্নালকে আটক করা গেলে। কারণ, ঘটনাটির পর থেকে ফিলিপের নাম উঠে আসছে একাধিক সন্দেহজনক তথ্য ও গোয়েন্দা অনুসন্ধানে।
এরই মধ্যে ফিলিপের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে দুই সহযোগীকে আটক করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (Border Guard Bangladesh – BGB)। সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলাম জানান, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার গাজীরভিটা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী ভুটিয়াপাড়া এলাকা থেকে ওই দুই সহযোগীকে আটক করা হয়।
আটক হওয়া ব্যক্তিরা হলেন—হালুয়াঘাট উপজেলার ভুটিয়াপাড়া এলাকার ক্লেমেন রিছিলের ছেলে সঞ্জয় চিসিম (২৫) এবং একই উপজেলার বিড়ইডাকুনী এলাকার চার্লস রিছিলের ছেলে সিবিরণ দিও (৩৫)। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্য অনুযায়ী, সঞ্জয় চিসিম ও সিবিরণ দিও দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারতে অবৈধভাবে লোক পারাপার চক্রের সঙ্গে যুক্ত। হাদির ওপর হামলাকারী ব্যক্তিকে হালুয়াঘাট সীমান্ত ব্যবহার করে পার করে দেওয়ার সম্ভাব্য ভূমিকার সন্দেহেই তাদের আটক করা হয়েছে।
এদিকে চার দিন পেরিয়ে গেলেও ইনকিলাব মঞ্চ (Inqilab Mancha)-এর মুখপাত্র ওসমান হাদির ওপর হামলাকারী ফয়সাল-আলমগীরের কোনো হদিস পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এর মধ্যে এলাকায় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, ঘটনার দিন শুক্রবার রাতেই তারা ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্ত ব্যবহার করে ভারতে পালিয়ে গেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ঘটনার পরপরই মিরপুর থেকে একটি প্রাইভেট কারে গাজীপুর হয়ে ময়মনসিংহে পৌঁছায় তারা। এরপর সেই গাড়ি থেকে নেমে অন্য আরেকটি প্রাইভেট কারে করে তাদের হালুয়াঘাট উপজেলার ধারাবাজার সংলগ্ন মুন ফিলিং স্টেশন পাম্পের পাশে নিয়ে যাওয়া হয়। গত শুক্রবার রাতে সেখানেই প্রাইভেট কার থামিয়ে ফিলিপ স্নাল নামে এক ব্যক্তির মোটরসাইকেলে করে দুই সন্দেহভাজনকে ভুটিপড়া সীমান্ত এলাকায় নেওয়া হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ফিলিং স্টেশনটির পাশের এলাকা নির্জন হওয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়নি।
ধারণা করা হচ্ছে, স্টেশনের পাশে দুইজনকে নামিয়ে দেওয়ার পর মোটরসাইকেলটি তুলে নিয়ে যান চালক। পরদিন শনিবার থেকেই ফিলিপ স্নালকে ধরতে যৌথভাবে অভিযান শুরু করে বিজিবি ও পুলিশ। কিন্তু অভিযানের কয়েক দিন পেরিয়ে গেলেও ফিলিপ এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এই ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক কে ছিলেন, তা এখনো নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। একই সঙ্গে আলমগীর ও ফয়সাল আদৌ ভারতে গিয়েছে নাকি দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে রয়েছে—সেই প্রশ্নও রয়ে গেছে অমীমাংসিত।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ভারত সীমান্তঘেঁষা গাজীরভিটা ইউনিয়নের ভুটিয়াপাড়া এলাকার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েই ফিলিপ স্নালের বাড়িতে যেতে হয়। বাড়ি থেকেই চোখে পড়ে ভারতের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া। ওই এলাকায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার নিচে একটি কালভার্ট রয়েছে, যেখানে বড় বড় সুড়ঙ্গ দেখা যায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধারণা, এই সুড়ঙ্গ পথ ব্যবহার করেই ঢাকায় হাদির ওপর হামলাকারী আলমগীর ও ফয়সালকে পাচার করা হয়ে থাকতে পারে।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, ফিলিপের মাধ্যমেই দুইজনকে ভারতে পাচারের কথা এখন এলাকায় মুখে মুখে শোনা যাচ্ছে। গত বুধবার ফিলিপকে এলাকায় দেখা গেলেও এরপর থেকে তাকে আর দেখা যায়নি। তার বাড়ি থেকে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া প্রায় ২০০ গজ দূরে। তিনি নিয়মিত ভারত যাতায়াত করতেন বলেও স্থানীয়দের ভাষ্য। ফিলিপ নালিতাবাড়ী উপজেলার বারমারি এলাকায় শ্বশুরবাড়ি এবং হালুয়াঘাটের ভুটিপাড়া বাবার বাড়ি—দুই জায়গাতেই বসবাস করতেন। স্থানীয়দের দাবি, এই পথ দিয়েই ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ভারতে পালিয়ে গেছেন।
ফিলিপ স্নালের ছোট বোন সালচি সনাল বলেন, ‘শুক্রবার সকালে অসুস্থ মাকে দেখতে বাড়িতে এলেও বিকেলেই চলে যায় ফিলিপ। এলাকায় বিল্লাল মেম্বারের সঙ্গে জমি নিয়ে শত্রুতার কারণে আমার ভাইকে জড়িয়ে পুলিশকে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার চাচাতো ভাই সঞ্জয় চিসিম ঘরে ঘুমাচ্ছিল। তাকে ঘর থেকে তুলে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করে কেন ধরে নিয়ে গেছে, আমরা জানি না। সে কোনো অপরাধ করলে কি বাড়িতে থাকত?’
সার্বিক বিষয়ে ময়মনসিংহ বিজিবির সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সরকার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হালুয়াঘাটের ধারাবাজার থেকে যে মোটরসাইকেলে করে অপরাধীদের সীমান্ত এলাকায় নেওয়ার কথা সন্দেহ করা হচ্ছে, সেটি বুটিয়াপাড়া এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। অপরাধীরা কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে পালিয়ে গেছে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যাবে ফিলিপকে ধরলেই। কীভাবে যোগাযোগ করা হয়েছে, কত টাকা লেনদেন হয়েছে, ওপারে কার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল—সব তথ্য তখন পরিষ্কার হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘শু’\টিং মিশনে অংশ নেওয়া দুজনসহ মানবপাচারে জড়িত ফিলিপকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে, একই সঙ্গে সীমান্তে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।’
এর আগে, গত ১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পর রাজধানীর পুরানা পল্টনের বক্স-কালভার্ট রোডে মোটরসাইকেলে আসা দুই ব্যক্তির একজন চলন্ত রিকশায় থাকা ওসমান হাদির মাথায় গু’\লি করে। গুরুতর অবস্থায় তাকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (Dhaka Medical College Hospital) এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতাল (Evercare Hospital)-এ নেওয়া হয়। পরবর্তীতে সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর (Singapore) পাঠানো হয়।
এদিকে হাদিকে হ’\ত্যা’\চেষ্টা মামলায় এখন পর্যন্ত ছয়জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের মধ্যে গু’\লি করার ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলের মালিক, সীমান্ত দিয়ে মানুষ পাচারকারী চক্রের দুই সদস্য এবং অভিযুক্ত ফয়সালের স্ত্রী, শ্যালক ও আরও এক নারী রয়েছেন।


