বহু জটিল চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে দেশে ফিরছেন তারেক রহমান

প্রায় ১৭ বছর পর নির্বাসিত জীবন শেষ করে আগামী ২৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশে ফিরছেন তারেক রহমান (Tarique Rahman)। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তার এই প্রত্যাবর্তন শুধু দলের অভ্যন্তরে নয়, দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা তৈরি করতে যাচ্ছে—এমনটাই বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষা, সংশয় ও সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে এই ফিরে আসার পেছনে যেমন রয়েছে আশা-আকাঙ্ক্ষা, তেমনি জমে উঠেছে বহুস্তরীয় চ্যালেঞ্জের স্তুপ।

রাজনৈতিক অঙ্গনে এই প্রত্যাবর্তনের প্রভাব যেমন ইতিবাচক উদ্দীপনার জন্ম দিচ্ছে, তেমনি বিশ্লেষকরা সাবধান করছেন—মনোনয়ন কেন্দ্রিক কোন্দল, নিরাপত্তা শঙ্কা, সংঘাতময় পরিস্থিতি এবং সামাজিক মাধ্যমে হ’\ত্যা ও অপপ্রচারের হুমকি নিয়েও। এমনকি একটা গোষ্ঠী নির্বাচন বানচালের জন্য ম’\ব ভা’\য়ে’\লেন্সে জড়াতে পারে বলেও শঙ্কা রয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ বলছেন, “মনোনয়ন নিয়ে গোলযোগ, দলে ভাঙন ঠেকানো, এবং জি’\উ’\আ’\র রহমান ও খা’\লে’\দা জিয়া’র আদর্শে স্থির থাকা—এই মুহূর্তে তারেক রহমানের মূল কর্তব্য। একই সঙ্গে তার ব্যক্তিগত ও দলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।”

এছাড়া ৫ আগস্টের পর গড়ে ওঠা রাজনৈতিক ঐক্যে ফাটল ধরেছে বলেও মত দেন তিনি। এই ঐক্য পুনঃস্থাপন ছাড়া বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ ঠেকানো অসম্ভব বলে মনে করছেন তিনি।

‘ফেইল স্টেট’ ঠেকানোর দায়িত্ব

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইতিহাসবিদ আলতাফ পারভেজের মতে, “বাংলাদেশকে একটি ‘ফেইল স্টেট’ বানানোর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত এখন স্পষ্ট। এই মুহূর্তে তারেক রহমানের প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে—এই চক্রান্ত রুখে দেওয়া। কারণ, তিনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা।”

তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের দিন পার হলেও রাজনৈতিক উত্তেজনা কমবে না। বরং আ’\ও’\মী লী’\গ এর রাজনৈতিক পুনরাবির্ভাব এবং দক্ষিণপন্থি রাজনীতির উত্থান নতুন চাপ সৃষ্টি করবে। তিনি বলেন, “তারেক রহমানকে দক্ষ ও দেশপ্রেমিক মধ্যপন্থি টিম গঠন করতে হবে, এবং কূটনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিতে হবে।”

দলীয় অভ্যন্তরের বাস্তবতা

বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরীর মতে, তৃণমূল পর্যন্ত দলকে পুনর্গঠনের কাজটি এখন সরাসরি তারেক রহমানকেই করতে হবে। “মনোনয়নকে ঘিরে কোন্দল বাড়ছে। নির্বাচনের পরের চ্যালেঞ্জ আরও বড়—জনগণের মালিকানা তাদের হাতে ফেরত দেওয়া। এজন্য দরকার দলের বাইরেও জনভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলা।”

তিনি সতর্ক করেন, “দুর্নীতিই বাংলাদেশের অর্ধেক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। এই দুর্নীতি দূর করতে পারলেই অনেকটা পথ এগোনো যাবে।”

নির্বাচনি প্রচারণায় তারেকের প্রভাব

দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ডিজিটাল পর্দায় দেখা তারেক রহমান এবার সরাসরি রাজপথে নামছেন। রাজনৈতিক গবেষকদের মতে, এটা বিএনপির জন্য এক বড় মনস্তাত্ত্বিক উত্তরণ। তৃণমূলের কর্মীরা পাবেন একপ্রকার মানসিক জ্বালানি। সেনাপতির সামনে থেকে নেতৃত্ব দলের কাঠামো ও গতিকে বদলে দিতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, “তারেক রহমান দেশে ফিরলে একটা শৃঙ্খলা আসবে। বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমন, নির্বাচনী মাঠে যথাযথ প্রচারণা এবং প্রশাসনিক পক্ষপাত থেকে দলকে রক্ষা করা—এসবেই তারেকের লিডারশিপ জরুরি হয়ে উঠবে।”

মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকদের পর্যবেক্ষণ

রাজধানীতে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, “বর্তমান সময়ে তারেক রহমানের জন্য সবচেয়ে সম্ভাবনাময় পরিসর তৈরি হয়েছে। তবে এই সময়ের চ্যালেঞ্জ অতীতের চেয়ে অনেক গভীর।”

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, “আগামী সরকার গঠনের সময়টি হবে স্বাধীনতার পর সবচেয়ে কঠিন। যে দল ক্ষমতায় আসবে, তাদের আচরণ, নেতৃত্ব ও বিনয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।”

তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিএনপি বেশি সহ্যশক্তি ও সমালোচনা গ্রহণের মানসিকতা দেখাবে। তারেক রহমান নিজেও বিভিন্ন সভায় বলেছেন—“বাংলাদেশ সম্ভাবনার দেশ। আমরা জনগণের আস্থা অর্জন করতে চাই। আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, নইলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যাবে না।”

৩১ দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার

তারেক রহমানের ভাষ্যে উঠে এসেছে, জনগণের আস্থা অর্জনের পাশাপাশি রাষ্ট্র পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ঘোষিত ৩১ দফা বাস্তবায়নই বিএনপির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এই কাজটি যদি সফলভাবে না হয়, তবে দেশ পিছিয়ে পড়বে বলেও তিনি সতর্ক করেন।

এই ঘোষণার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে তৎপরতা আরও বেড়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে এখন প্রশ্ন—বিএনপি কি শুধু প্রত্যাবর্তন নয়, সংগঠনের ভারসাম্য, কৌশল ও প্রশাসনিক প্রস্তুতির দিক থেকেও প্রস্তুত?

আগামী ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমান ঢাকায় পা রাখার পর তার এই প্রত্যাবর্তন বাস্তবতায় কতটা রাজনৈতিক পরিবর্তন আনবে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছে গোটা জাতি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *