মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (Human Rights Support Society) (এইচআরএসএস) ফেব্রুয়ারি মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত মাসে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবস্থা অত্যন্ত হতাশাজনক ছিল।
রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা
এইচআরএসএস-এর প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে,
“গণ-অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) পালিয়ে যাওয়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus) এর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে।”
তবে এই পরিবর্তনের পরও জনগণ স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ উপভোগ করতে পারেনি এবং সরকার সংশ্লিষ্টরা এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ফেব্রুয়ারি মাসে রাজনৈতিক সহিংসতা, গণপিটুনিতে হত্যা, সাংবাদিক নির্যাতন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণের মতো ঘটনা বেড়েছে। বিচারবহির্ভূত হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন, মাজারে হামলা, ভাঙচুর, চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো অপরাধ বৃদ্ধির কারণে জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
ছাত্রদের বিক্ষোভ ও রাজনৈতিক সহিংসতা
প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে ৫-৭ ফেব্রুয়ারি বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে অবস্থিত শেখ মুজিবুর রহমানের (Sheikh Mujibur Rahman) বাড়ি, শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদন, এবং সারা দেশে আওয়ামী লীগের (Awami League) কার্যালয় ও নেতাদের বাড়িঘরে হামলা চালায়।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ দেখা দেয়। ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের (A. K. M. Mozammel Haque) বাড়িতে হামলার ঘটনায় আবুল কাসেম নামে একজন শিক্ষার্থী নিহত হন এবং আরও ১৫-১৬ জন আহত হন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে প্রাণহানি
দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে একটি বিশেষ অভিযান পরিচালিত হলেও এতে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।
এইচআরএসএস-এর তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে ১০৪টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনায় ৯ জন নিহত এবং ৭৫৫ জন আহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৫৮টি ঘটনা বিএনপির অন্তর্কলহজনিত, যেখানে ৫ জন নিহত ও ৪৯৪ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৫ জন বিএনপির, ১ জন আওয়ামী লীগের, ১ জন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনের, এবং ২ জনের রাজনৈতিক পরিচয় মেলেনি, যার মধ্যে একজন নারী।
ফেব্রুয়ারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে ৩ জন নিহত হন।
- ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে মিরাজ হোসেন ও মো. জুম্মন নামের দুই যুবক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
- ২৪ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে বিমান বাহিনী ঘাঁটির সংলগ্ন সমিতিপাড়ায় স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে শিহাব কবির নাহিদ (৩০) নামে এক ব্যক্তি নিহত হন এবং আরও কয়েকজন আহত হন।
সাংবাদিক নির্যাতন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা
এইচআরএসএস-এর তথ্য অনুযায়ী,
- ১৯টি হামলার ঘটনায় ৩৪ জন সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন।
- ১৬ জন আহত, ২ জন লাঞ্ছনার শিকার, ৪ জন হুমকির সম্মুখীন, এবং ১ জন গ্রেফতার হয়েছেন।
- ৫টি মামলায় ১১ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
সংখ্যালঘু ও শ্রমিক নির্যাতন
ফেব্রুয়ারিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অন্তত ৩টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৬টি প্রতিমা ভাঙচুর এবং জমি দখলের ১টি ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।
এছাড়া, ২৬টি শ্রমিক নির্যাতনের ঘটনায় ১২ জন নিহত ও অন্তত ৮৭ জন আহত হয়েছেন।
নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র
এইচআরএসএস-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী,
- ১০৭ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
- ৫৩ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে ৩৮ জন ১৮ বছরের কম বয়সী।
- ১০৪ জন শিশুর ওপর নির্যাতন হয়েছে, যার মধ্যে ২৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৭৫ জন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এইচআরএসএস-এর প্রতিবেদন স্পষ্টভাবে দেখায় যে, ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি অত্যন্ত নাজুক ছিল। রাজনৈতিক সহিংসতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, নারী ও শিশু নির্যাতন, সংখ্যালঘু ও সাংবাদিক নিপীড়নসহ বিভিন্ন ঘটনায় জনমনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। সংস্থাটি আরও বলছে, এই পরিস্থিতি সামাল দিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।