বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। জাতীয় নাগরিক পার্টির (National Citizen Party) মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ (Hasnat Abdullah) দাবি করেছেন যে সেনানিবাস থেকে তাদের ওপর একটি সংশোধিত আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী (Bangladesh Army)। সেনা সদর দপ্তরের বিবৃতিতে স্বীকার করা হয়েছে যে ১১ মার্চ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান (Waqar-Uz-Zaman)-এর সঙ্গে হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের বৈঠক হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনী দাবি করেছে, এই বৈঠক ছিল ছাত্রনেতাদের আগ্রহে, এবং কোনো চাপ প্রয়োগ করা হয়নি।
বিবৃতিতে বলা হয়, “হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সারজিস আলম দীর্ঘদিন যাবৎ সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য ইচ্ছা পোষণ করছিলেন। পরবর্তীতে সারজিস আলম ১১ই মার্চ ২০২৫ তারিখে সেনাপ্রধানের মিলিটারি এডভাইজারকে ফোন দিয়ে সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাতের জন্য সময় চান। এর প্রেক্ষিতে মিলিটারি এডভাইজার তাদেরকে সেনাসদরে আসার জন্য বলেন।”
“অতঃপর ১১ই মার্চ দুপুরে সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাহ সেনাসদরে না এসে সরাসরি সেনাভবনে সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেন। পরবর্তীতে সেনাপ্রধান অফিস কার্যক্রম শেষ করে সেনা ভবনে এসে তাদের সঙ্গে দেখা করেন।”
সেনানিবাসের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিয়ে বিতর্ক
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর, সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে।
হাসনাত আব্দুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেছেন, ভারতের পরিকল্পনার আলোকে সেনাবাহিনী একটি ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ গঠনের পরিকল্পনা করছে, যেখানে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের অপরাধ স্বীকার করার শর্তে কিছু নির্দিষ্ট নেতাকে সামনে আনা হবে।
তিনি আরও বলেন, ১১ মার্চ সেনানিবাসে তাদের ডেকে নিয়ে এই নতুন আওয়ামী লীগকে মেনে নিতে বলা হয়, এবং সংসদীয় আসন ভাগাভাগির প্রস্তাবও দেওয়া হয়। সেনাসদর যদিও এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে, তবে তারা স্বীকার করেছে যে সেনাপ্রধান ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে।
সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ভূমিকা কতটা গ্রহণযোগ্য?
বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক ভূমিকা নতুন নয়। অতীতে ১৯৭৫, ১৯৮২ ও ২০০৭ সালে সেনা হস্তক্ষেপের নজির রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরও সেনাবাহিনী যে নিরপেক্ষ থাকবে, তা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে সন্দেহ রয়েছে।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সেনানিবাসে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে গোপন বৈঠক হওয়া এবং ক্ষমতা পুনর্বিন্যাসের আলোচনায় সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সেনাবাহিনীর ব্যাখ্যা ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
সেনাসদর থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান ছাত্রনেতাদের সঙ্গে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন, তবে কোনো চাপ প্রয়োগ করেননি। সেনাবাহিনী আরও বলেছে, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে তা আন্তর্জাতিক মহলে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে, এবং এজন্য অপরাধমুক্ত আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে নতুন দল গঠনের সম্ভাবনার কথা আলোচনায় এসেছে।
তবে এই ব্যাখ্যা অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। সেনাবাহিনী যদি রাজনৈতিক দলগুলোর পুনর্গঠনে ভূমিকা নেয়, তবে সেটি একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য উদ্বেগজনক।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া
জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী (Nasiruddin Patwari) বলেছেন, হাসনাত আব্দুল্লাহর ফেসবুক পোস্ট শিষ্টাচারবহির্ভূত। তবে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (Nahid Islam) এখনো এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সেনাবাহিনী যদি সত্যিই নিরপেক্ষ থাকতে চায়, তবে তাদের উচিত রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা।
গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কোন পথে?
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে এখনই স্পষ্ট করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সেনাবাহিনী জড়িত হলে তা দেশের গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীর অতীত রেকর্ড এবং বর্তমান বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ রক্ষায় সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তথ্যসূত্র : নেত্র নিউজ