বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে এখন চলছে নানা খেলা। আর সেই খেলার অভ্যন্তরীণ চিত্র বুঝতে হলে চিনতে হবে এর নেপথ্যের ব্যক্তিদের। রাজনীতির মাঠের নেপথ্যের খেলোয়াড়দের , তা জানা থাকলে পুরো পরিস্থিতি বোঝা সহজ হয়।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক মহলে একটি নাম আলোচিত হচ্ছে—নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন। তার ভূমিকা নিয়ে অনেকে কথা বললেও তার সম্পর্কে বিশদ তথ্য খুব কম মানুষই জানেন।
পরিচয় ও পারিবারিক সংযোগ
কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (Dr. Zafrullah Chowdhury)। তার ভায়রা হলেন নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন। অর্থাৎ, শিরিন হক (Shireen Haq)-এর বোন নাসরিন হক (Nasreen Huq)-এর স্বামী তিনি।
এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই উঠে আসতে পারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—এবি পার্টি (AB Party), জামায়াতে ইসলামি (Jamaat-e-Islami), গণঅধিকার পরিষদ (Gono Odhikar Parishad), চরমোনাই (Charmonai), হেফাজতে ইসলাম (Hefazat-e-Islam), ডিজিএফআই (DGFI), ফরহাদ মজহার (Farhad Mazhar), ওয়ান ইলেভেন (One-Eleven), এবং এমনকি প্রথম আলো (Prothom Alo) পর্যন্ত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রথম বিতর্কিত কর্মকাণ্ড
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Dhaka)-এ পড়ার সময় থেকেই ছোটন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। বিশেষ করে আশির দশকে তিনি সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সেই সময় এরশাদ (Ershad) সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় শ্রমিক ও কৃষকদের সচিবালয়ে ঢুকিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালানোর জন্য তার নাম উঠে আসে। তখনকার ওয়ার্কার্স পার্টি (Workers’ Party)-র নেতা হিসেবে তিনি ভুল তথ্য ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছিলেন।
বিএনপির ভেতরে ছোটনের অবস্থান
২০০১ সালে বিএনপি (BNP) সরকার গঠনের পর ভারতপন্থী গোষ্ঠী কীভাবে হাওয়া ভবন (Hawa Bhaban)-এ প্রবেশ করে, তা নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ছোটন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
ছোটন একসময় বিএনপির ঘনিষ্ঠ হলেও আদর্শিকভাবে তিনি ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিলেন। তার প্রভাব এতটাই ছিল যে, তিনি সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমান (Shafik Rehman)-এর পাশে দাঁড়িয়ে যায়যায়দিন (Jaijaidin) পত্রিকায় জায়গা করে নেন।
২০০৬ সালে বিএনপি বিরোধী প্রচারণায় ডিজিএফআইয়ের মদদে যখন ব্যাপক আক্রমণ শুরু হয়, তখন তার নেপথ্যে ছোটনের ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
যায়যায়দিনের নিয়ন্ত্রণ ও ষড়যন্ত্র
ছোটনের চক্রান্তের অন্যতম লক্ষ্য ছিল যায়যায়দিনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়া। বসুন্ধরা গ্রুপের এক পরিচালক হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার (The Daily Star) যখন বসুন্ধরার বিরুদ্ধে রিপোর্ট প্রকাশ করছিল, তখন ছোটন শফিক রেহমানকে দোষারোপ করেন। ফলে বসুন্ধরা গ্রুপ যায়যায়দিনের আর্থিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়।
এরপর ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে ছোটন শফিক রেহমানকে সরিয়ে দিয়ে যায়যায়দিনের নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শফিক রেহমান তার গোটা ছোটন বাহিনীকে বরখাস্ত করে লন্ডনে গিয়ে নিজের বাড়ি বিক্রি করে পত্রিকাটি চালানোর উদ্যোগ নেন।
ওয়ান ইলেভেন ও ছোটনের ভূমিকা
ওয়ান ইলেভেনের সময় বিএনপির অভ্যন্তরে একটি চক্র সক্রিয় ছিল, যারা মূলত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উত্থানে ভূমিকা রাখে। সেই সময় খোদ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া (Khaleda Zia)-র বক্তৃতা লেখক শফিক রেহমানকে বেআইনিভাবে বিমান থেকে নামিয়ে আনার ঘটনায় ছোটনের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
পরে শফিক রেহমান পত্রিকাটি এইচআরসি গ্রুপ (HRC Group)-এর ব্যবসায়ী সাঈদ চৌধুরীকে লিখে দিতে বাধ্য হন, যিনি আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হোসেন চৌধুরী (Saber Hossain Chowdhury)-র ভাই।
ফরহাদ মজহারের গুম ও ছোটনের ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নেপথ্যের খেলোয়াড়রা কতটা শক্তিশালী ও কৌশলী হতে পারেন, তার অন্যতম উদাহরণ হলেন নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন (Nurul Islam Bhuiyan Choton)। বিশেষ করে, ২০১৭ সালের আলোচিত ফরহাদ মজহার (Farhad Mazhar)-এর গুমের ঘটনায় তার ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে আসে।
ফরহাদ মজহারের গুম ঘটনাটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। প্রথমে দাবি করা হয় যে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ তাকে অপহরণ করেছিল, তবে পরবর্তীতে জানা যায়, তিনি এক গর্ভবতী হিন্দু নারীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, যিনি তার সন্তানের মা হতে যাচ্ছিলেন। র’ তাকে সীমান্তের ওপারে নিতে চাইলেও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও র্যাবের তৎপরতায় তারা ব্যর্থ হয়।
পুলিশ পরে তাকে মানসিক চাপে ফেলতে জোরপূর্বক বিভিন্ন কাজে বাধ্য করে, যার মধ্যে ছিল গর্ভবতী নারীর কাছে টাকা পাঠানো, স্ত্রীর কাছে ৩৫ লাখ টাকা দাবি করা এবং খুলনার মার্কেটে ঘোরাঘুরি করা।
ফরহাদ মজহারের অনুসারী মোহাম্মদ রোমেল জানান যে, তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ বহু পুরনো এবং নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন, পিনাকী ভট্টাচার্য, গৌতম দাশসহ অনেকে বিষয়টি জানতেন। তবে তার গুমের পর তারা তার পক্ষে অবস্থান না নিয়ে বরং তার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে রাজনৈতিকভাবে তাকে একঘরে করে দেন।

২০১৩ সালের পর সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভারতবিরোধী অংশকে কোণঠাসা করতে পরিকল্পিতভাবে চক্রান্ত চালানো হয়। এই কাজে সক্রিয় ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মজিবুর রহমান মঞ্জু ও হেফাজতে ইসলাম, এবং এই পুরো ষড়যন্ত্রের মধ্যমণি ছিলেন ছোটন।
ফরহাদ মজহারের গুমের ঘটনা ছোটন ও তার সহযোগীরা র’ এর ভাষ্যকে কাজে লাগিয়ে তাকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে ফেলার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে তিনি ও মাহমুদুর রহমান ক্রমশ রাজনীতির বাইরে চলে যান, এবং এবি পার্টি প্রকল্পও তাদের হাতছাড়া হয়।
এবি পার্টির অভ্যন্তরীণ সংকট: নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটনের প্রভাব
জামায়াতে ইসলামীর (Jamaat-e-Islami) ভেতরে সাম্প্রতিক সময়ে মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক নতুন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিভ্রান্তির অন্যতম কারিগর হিসেবে উঠে এসেছে আদর্শচ্যুত বামপন্থী ও ডিপ স্টেটের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন (Nurul Islam Bhuiyan Choton)।
ছোটনের প্রভাবের কারণে জামায়াতের একটি অংশ সংস্কারপন্থী ইসলামি রাজনৈতিক ধারা থেকে সরে এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুসারী হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ফরহাদ মজহার (Farhad Mazhar)-এর অনুসারীদের হাত ধরে জামায়াতের সংস্কারপন্থীদের মধ্যে মতাদর্শিক পরিবর্তন ঘটেছে।
জামায়াতের সংস্কারপন্থার উত্থান ও মার্কিন প্রভাব
সংস্কারপন্থী ইসলামি রাজনৈতিক চিন্তার মূলধারা গড়ে ওঠে ২০০০-এর দশকে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের “ওয়ার অন টেরর” নীতির অংশ হিসেবে মুসলমানদের মধ্যে উদারপন্থী ও আধুনিকতাবাদীদের কাছে টানার কৌশল নেওয়া হয়। এই চিন্তার অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক (Barrister Abdur Razzaq)।
আবদুর রাজ্জাক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন এবং ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। এমনকি ২০১৩ সালে আবদুল কাদের মোল্লা (Abdul Quader Mollah)-র ফাঁসির পর গোয়েন্দা সংস্থা র’ তাকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা করে, কিন্তু মার্কিন হস্তক্ষেপে তিনি দেশত্যাগে সক্ষম হন।
সংস্কারপন্থী এই ধারার আরেক নেতা ছিলেন আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (Ali Ahsan Mohammad Mojaheed)। তিনি তুরস্কের একেপি পার্টি (AK Party) দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং দলীয় সংস্কারের লক্ষ্যে তুরস্ক সফর করেন।

জামায়াতের ভেতরের বিভক্তি ও মিডিয়া প্রভাব
সংগঠনের ভেতরে দুটি আলাদা সংস্কারপন্থী ধারা গড়ে ওঠে—একটি আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে এবং অন্যটি মুজাহিদের নেতৃত্বে। এই বিভক্তির প্রভাব পড়ে শিবিরের বিভিন্ন স্তরে।
সংস্কারপন্থীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন মীর কাসেম আলী (Mir Quasem Ali), যিনি ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং নয়া দিগন্ত ও দিগন্ত টিভি প্রতিষ্ঠা করেন। এসব মিডিয়ার মাধ্যমে জামায়াত ও শিবিরপন্থী সংস্কৃতিকর্মীদের একটি বড় অংশ কর্মসংস্থান পায় এবং আদর্শগতভাবে নতুন ধারা তৈরি হয়।
তবে সময়ের সাথে সাথে মীর কাসেম আলীর মাধ্যমে ফরহাদ মজহারের চিন্তার সঙ্গে জামায়াতপন্থী সংস্কারপন্থীদের সংযোগ বাড়তে থাকে, যা ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার সময় আরও জোরালো হয়।
নতুন রাজনৈতিক দলের পরিকল্পনা ও এ বি পার্টির অভ্যুত্থান
২০১০ সালে জামায়াতের অভ্যন্তরে বড় পরিবর্তন আসে, যখন মুজাহিদ গ্রুপের চাপের মুখে শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতির পদ থেকে শিশির মনিরকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এতে আবদুর রাজ্জাক ও মীর কাসেম আলীর অনুসারীরা একত্রিত হয়।
২০১২-১৩ সালের দিকে ফরহাদ মজহারের ঘনিষ্ঠদের মাধ্যমে জামায়াত থেকে সংস্কারপন্থীদের আলাদা করার পরিকল্পনা শুরু হয়। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়ায় জামায়াতপন্থী প্রবাসীদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়, যেখানে ফরহাদ মজহার বক্তৃতা দেন।
মুজিবুর রহমান মঞ্জু (Mujibur Rahman Manju) ও তার অনুসারীরা ফরহাদ মজহার এবং ছোটনের প্রভাববলয়ে চলে আসেন। ফলে তারা ইসলামপন্থী রাজনীতির সংস্কারের স্লোগান থেকে সরে গিয়ে কার্যত সেক্যুলার রাজনৈতিক দর্শন গ্রহণ করেন।

ছোটনের ভূমিকা ও এ বি পার্টির চূড়ান্ত রূপ
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (Dr. Zafrullah Chowdhury)-র মাধ্যমে ছোটনের সরাসরি সংযোগ গড়ে ওঠে ফরহাদ মজহারের অনুসারীদের সঙ্গে। এ সময় মঞ্জু ও তার সহযোগীরা ছোটনের নেটওয়ার্কের অধীনে চলে আসেন, যেখানে পিনাকী ভট্টাচার্য (Pinaki Bhattacharya) এবং আবু মুস্তাফিজ হাসান শাপলু (Abu Mustafiz Hasan Shaplu) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
এর ফলে মঞ্জু ও তার অনুসারীরা ইসলামী রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এবং সেক্যুলার রাজনৈতিক চিন্তাকে গ্রহণ করে। এ বি পার্টি গঠনের মাধ্যমে এই রাজনৈতিক রূপান্তর চূড়ান্ত রূপ নেয়।
জামায়াত, এবি পার্টি ও রাজনীতির নেপথ্যের হিসাব-নিকাশ
বাংলাদেশের রাজনীতির গোপন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সম্পর্ক ও অন্তর্দ্বন্দ্ব নতুন মোড় নিচ্ছে। সম্প্রতি উঠে এসেছে জামায়াতে ইসলামীর (Jamaat-e-Islami) সাবেক আমীর মকবুল আহমেদ (Maqbul Ahmad) ও অন্যান্য নেতাদের আত্মগোপনের খবর। দাবি করা হচ্ছে, তারা ছিলেন মেসবাহ সাঈদের (Mesbah Saeed) বাসায়, যার পরিবার রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ (Awami League)-ঘনিষ্ঠ।
ছোটন ও ডিজিএফআই সংযোগ
এমন এক ভবনে মেসবাহ সাঈদের বাসা যেখানে একই ভবনের আরেক ফ্ল্যাটে থাকেন নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন (Nurul Islam Bhuiyan Choton)। তাকে ডিজিএফআই-ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, জামায়াতের শীর্ষ নেতারা যেখানে আত্মগোপনে ছিলেন, সেই একই ভবনে ছোটনের অবস্থান কতটা কাকতালীয়?
শিবির ও জামায়াতের একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়, মেসবাহ সাঈদ এবং তার সহযোগীরা নানা বিতর্কিত কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে মদ্যপান ও নারী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও রয়েছে। তবুও তাকে জামায়াতের ঢাকা মহানগরের শুরা সদস্য করা হয়েছে এবং ফেনীতে উপজেলা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী করা হয়েছে।
এবি পার্টির সঙ্গে সংযোগ
মেসবাহ সাঈদের রাজনৈতিক যোগাযোগ কেবল জামায়াতেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি এবি পার্টি গঠনের প্রক্রিয়াতেও যুক্ত ছিলেন এবং মজিবুর রহমান মঞ্জু (Mujibur Rahman Manju)-র ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এবি পার্টির অন্যতম অর্থায়নকারী ছিলেন বায়োফার্মার এমডি লকিয়তুল্লাহ। জানা গেছে, মেসবাহ সাঈদ যুবলীগের ঢাকা মহানগরের কিছু নেতার মাধ্যমে লকিয়তুল্লাহর প্রতিষ্ঠান ও অর্থ আত্মসাৎ করেন।
এবি পার্টি এবং ছোটনের সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও কার্যকরী পরিষদের সদস্যরা জানিয়েছেন, এবি পার্টির প্রচারণায় শিবিরের আইটি বিভাগ জড়িত ছিল। বিশেষ করে গার্ডিয়ান প্রকাশনীর (Guardian Publications) সঙ্গে যুক্ত নূর মোহাম্মদ (Noor Mohammad)-র গ্যাং এই প্রচারণায় সক্রিয় ছিল।
পিনাকী ভট্টাচার্য কানেকশন
এখানে আরেকটি বড় নাম উঠে এসেছে—পিনাকী ভট্টাচার্য (Pinaki Bhattacharya)। জামায়াত ও ইসলামপন্থীদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য একটি বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। তার অংশ হিসেবে পিনাকী ভট্টাচার্য “মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম” বইটি লেখেন, যা গার্ডিয়ান প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। শিবিরের আইটি বিভাগ, যারা একসময় অনলাইনে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী প্রচারণা চালাত, তারাই ২০১৭ সালের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামী আদর্শের আলোকে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে।
এই প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনায় মূল ভূমিকা রাখে ছোটন-পিনাকী-মেসবাহ সাঈদ-নূর মোহাম্মদের গ্যাং। এমনকি সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের (Syed Abdullah Mohammad Taher)-র বক্তব্যেও দেখা গেছে জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসার প্রবণতা।
জামায়াত-বিএনপি জোট ভাঙার পরিকল্পনা
আরেকটি বড় এজেন্ডা ছিল জামায়াতকে বিএনপি (BNP)-র সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকার চিন্তা থেকে সরিয়ে আনা। মেসবাহ সাঈদ-নূর মোহাম্মদদের গ্যাং অনলাইনে বিএনপি-বিরোধী প্রচারণা চালিয়েছে, যাতে জামায়াতের তরুণদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের চিন্তা দৃঢ় হয়।
চরমোনাই ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংযোগ
অন্যদিকে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ (RAW)-র মদদপুষ্ট চরমোনাই পন্থীদের ইসলামপন্থী তরুণদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ছোটন-মেসবাহ সাঈদ-নূর মোহাম্মদ গ্যাং চরমোনাইয়ের প্রচারণায় সক্রিয় ছিল।
চরমোনাই পীর (Charmonai Pir)-র অনুসারীরা জামায়াতের ফাঁসি হওয়া নেতাদের শহীদ মনে করে না, তবুও জামায়াতের কিছু অংশ তাদের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে, যা ছোটনের নেপথ্যে থাকার ইঙ্গিত দেয়। বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময়ও চরমোনাইয়ের প্রার্থীদের জন্য মেসবাহ-নূরা-মাহমুদ গ্যাং প্রচারণা চালিয়েছে। পরবর্তীতে যখন চরমোনাইয়ের নেতারা আওয়ামী লীগের হামলার শিকার হন, তখন এই গ্যাং জামায়াত-চরমোনাই ঐক্যের প্রচারণা শুরু করে।
‘অন্তর্বর্তীকালীন চক্র’—একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে, যারা মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে ক্ষমতার বাইরে রাখার জন্য কৌশলীভাবে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এই চক্রের মূল লক্ষ্য হলো, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে দেশকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করা।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বিতর্কিত নিয়োগ
বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার (Odhikar)-এর প্রেসিডেন্ট সি আর আবরার (C.R. Abrar)-কে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে এই চক্র তাদের অবস্থান আরও সুসংহত করেছে। তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম ও প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলো নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। এর ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েও জনমনে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে।
একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠী রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল করতে কাজ করছে। বিশেষ করে বিএনপি (BNP), জামায়াতে ইসলামি (Jamaat-e-Islami), এমনকি আওয়ামী লীগ (Awami League) যেন সুসংগঠিত হয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে, সে জন্য গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা ও চক্রের মূল বাধা
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করার পথে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান (General Waker-Uz-Zaman)-কে। এই চক্রের মূল পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা এবং সামরিক নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করা, যাতে তারা দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে না পারে।
বিএনপি ও জামায়াতকে কোণঠাসা করার নীলনকশা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই গোষ্ঠী বিএনপি ও জামায়াতকে দুর্বল করার জন্য নানামুখী কৌশল গ্রহণ করেছে। জামায়াতকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে বিভিন্ন গোষ্ঠীকে ব্যবহার করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংকটকেও সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে।
এছাড়াও, বাংলাদেশে রাজনৈতিক উত্তেজনা বৃদ্ধি করতে এই চক্র একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে অহেতুক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। এটি দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
নতুন রাজনৈতিক দলের ওপর চক্রের প্রভাব
রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন একটি ছাত্রসংগঠন গঠনের সম্ভাবনা দেখা দিলেও, সেটিকে বারবার ভুল পথে পরিচালিত করা হচ্ছে। এই চক্রের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী ফরহাদ মজহার (Farhad Mazhar) এবং পর্দার আড়ালে থাকা ছোটন (যার সম্পর্কে অনেকেই অবগত নন) ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনাকে বিপথগামী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে সম্ভাবনাময় তরুণ নেতৃত্ব দিকভ্রান্ত হচ্ছে, যা সামগ্রিকভাবে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সচেতনতা ও আগাম সতর্কবার্তা
রাজনীতির পর্দার আড়ালে থাকা নেটওয়ার্কগুলো কীভাবে কাজ করে, তা বোঝার জন্য এই বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ। ছোটন ও তার সহযোগীরা কীভাবে ইসলামপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, জামায়াত-বিএনপি জোট দুর্বল করা, এবি পার্টি গঠন এবং চরমোনাইকে প্রতিষ্ঠিত করার মতো নানা কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিল, তার স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। দেশের রাজনীতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার জন্য এই চক্র যে নানামুখী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ নাগরিকদের সতর্ক থাকা জরুরি। তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য যথাসময়ে উন্মোচিত হবে, যা দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতির গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।