জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া ৩১ দফা সুপারিশের বেশ কয়েকটি বিষয়ে বিএনপি (BNP) দ্বিমত পোষণ করেছে। বিশেষ করে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকে একই পর্যায়ে বিবেচনা করার সুপারিশ দলটি প্রত্যাখ্যান করেছে। একই সঙ্গে, কমিশনের প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধন ও রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের সুপারিশের বিরুদ্ধেও নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে বিএনপি।
রবিবার জাতীয় সংসদে ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ (Ali Riaz)-এর কাছে দলের মতামত জমা দেয় বিএনপি। পরে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ (Salahuddin Ahmed) এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন।
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে বিএনপির দৃষ্টিভঙ্গি
**১. একাত্তর ও ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের তুলনা
ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান উভয়ই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তবে বিএনপি মনে করে, দুই ঘটনাকে এক কাতারে ফেলা যুক্তিযুক্ত নয়। দলটির মতে, মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশ স্বাধীনের লড়াই, আর ২০২৪ সালের আন্দোলন ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক সংগ্রাম।
২. সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় নাম পরিবর্তন:
বিএনপি স্পষ্ট করেছে যে তারা রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের পক্ষে নয়। ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে বাংলাদেশের নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ থেকে ‘ফেডারেল বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। বিএনপির মতে, এটি অনর্থক এবং রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অপ্রয়োজনীয়। সংবিধানের পূর্বাবস্থা বহাল রাখার পক্ষেই দলটি মত দিয়েছে।
৩. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা:
বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সুপারিশগুলোর সঙ্গে একমত। দলটি সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অধস্তন আদালতের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ সুপ্রিম কোর্টের হাতে দেওয়ার পক্ষে। এছাড়া, লোয়ার জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবও বিএনপির সমর্থন পেয়েছে।
৪. দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কার:
বিএনপি দুদক (ACC) সংস্কারের জন্য কমিশনের ২০টি সুপারিশের মধ্যে ১১টিতে সরাসরি সমর্থন দিয়েছে। ৭-৮টি সুপারিশ নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য মনে করলেও, একটি সুপারিশে দলটি দ্বিমত পোষণ করেছে।
৫. প্রশাসন সংস্কার:
প্রশাসন সংস্কারের ২৬টি প্রস্তাবনার মধ্যে বিএনপি প্রায় অর্ধেকের সঙ্গে একমত হয়েছে। তবে বিদ্যমান সিনিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) বাতিল করে নতুন মন্ত্রিপরিষদ কমিটি গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে দলটি।
৬. নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা:
নির্বাচন কমিশন (Election Commission) যে কোনো সংসদীয় কমিটির কাছে জবাবদিহি করবে—এমন সুপারিশকে বিএনপি অযৌক্তিক বলে মনে করছে। দলটি মনে করে, নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এর কার্যক্রমে সংসদীয় কমিটির হস্তক্ষেপ কাম্য নয়।
৭. এনআইডি কার্যক্রম:
এনআইডি কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার প্রস্তাবও বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। দলটির মতে, এটি নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব করবে এবং রাজনৈতিক প্রভাব বাড়াবে।
৮. সীমানা পুনর্নির্ধারণ:
বিএনপি মনে করে, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা পুনরায় নির্বাচন কমিশনের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত। দলটি কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে একমত হয়ে এটি বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছে।
৯. গণপরিষদ নয়, সংসদ নির্বাচন :
সংবিধান সংস্কারে গণপরিষদ গঠন করার কোনো প্রয়োজন নেই বলে মনে করে বিএনপি। দলটি বলেছে, আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা উচিত। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা হলে সংসদে সব আলোচনা হবে।
১০. দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টে বিএনপির ভিন্নমত:
বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের ধারণা গ্রহণ করলেও, উচ্চকক্ষের আসন সংখ্যা ও মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে মতপার্থক্য রয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রস্তাব সবাই গ্রহণ করেছে এবং জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। সংস্কার কমিশন ১০৫ জন প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব দিয়েছে, কিন্তু বিএনপি এটিকে ১০০ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষে।”
তিনি আরও জানান, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে বিএনপি উচ্চকক্ষে ১০০ আসন রাখার প্রস্তাব করেছে এবং বর্তমান মনোনয়ন পদ্ধতিই বহাল রাখার সুপারিশ করেছে। তবে, কমিশনের সঙ্গে এই মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়েও মতপার্থক্য রয়েছে বলে জানান তিনি।
১১ সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আদলে লোয়ার জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব :
নিম্ন আদালতের জন্য আলাদা কাউন্সিলের প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি।
এ প্রসঙ্গে সালাহউদ্দিন বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, সেটা অলরেডি পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় হাইকোর্টের রায়ে বহাল হয়েছে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের আদলে লোয়ার জুডিশিয়ারির জন্য লোয়ার জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করেছি।
১২. জরুরি অবস্থা ঘোষণায় দ্বিমত :
জাতীয় সাংবিধানিক কমিশনের (এনসিসি) সিদ্ধান্তক্রমে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন—সংবিধান সংস্কার কমিশনের এমন সুপারিশের সঙ্গে একমত হয়নি বিএনপি। দলটি বলেছে, জরুরি অবস্থা জারির সঙ্গে সরকারের নির্বাহী কর্তৃত্বের বিষয়টি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত হওয়ায় এসংক্রান্ত ক্ষমতা সরকার ও সংসদের বাইরে অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা সংগত নয়।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশে আরো বলা হয়, জরুরি অবস্থার সময় নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত করা যাবে না এবং আদালতে যাওয়ার অধিকার বন্ধ বা স্থগিত করা যাবে না। তাই অনুচ্ছেদ ১৪১(খ) ও অনুচ্ছেদ ১৪১(গ) বাতিল হবে।
এই প্রস্তাবের সঙ্গেও একমত নয় বিএনপি। দলটির মতামত, নাগরিকদের কোনো অধিকার রদ বা স্থগিত না করে জরুরি অবস্থা জারির কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে, প্রস্তাবিত সুপারিশে তা বোধগম্য নয়।
১৩ রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য :
বিএনপি রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য বিষয়ে নীতিগত ভাবে একমত হলেও বিস্তারিত ক্ষমতা বন্টনের প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু দ্বিমত পোষন করেছে।
কমিশনের দেওয়া ৩১ দফা সুপারিশের বেশ কয়েকটি বিষয়ে বিএনপি (BNP) দ্বিমত পোষণ করেছে। বিশেষ করে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানকে একই পর্যায়ে বিবেচনা করা, সংবিধান সংশোধন এবং রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের সুপারিশ দলটি প্রত্যাখ্যান করেছে।
রবিবার জাতীয় সংসদে ঐকমত্য কমিশনের কো-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ (Ali Riaz)-এর কাছে দলের মতামত জমা দেয় বিএনপি। পরে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ (Salahuddin Ahmed) এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির বিস্তারিত প্রতিক্রিয়া তুলে ধরেন।
বিএনপির বক্তব্য:
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশের বেশিরভাগই আমাদের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে কিছু সুপারিশ বাস্তবতা বিবেচনা না করেই করা হয়েছে, যা গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বজায় রেখে বাস্তবসম্মত সংস্কার চাই।”
তিনি আরও বলেন, “বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি দমন, প্রশাসন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার—এসব বিষয়ে আমরা একমত। কিন্তু একাত্তর ও ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনকে একসঙ্গে বিবেচনা করা এবং রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের মতো সুপারিশ আমরা গ্রহণ করতে পারছি না।”
সংক্ষেপে বিএনপির অবস্থান:
✅ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সুপারিশ সমর্থন
✅ দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের বেশিরভাগ সুপারিশের প্রতি সমর্থন
✅ প্রশাসন সংস্কারের কয়েকটি সুপারিশের প্রতি নীতিগত সমর্থন
✅ সীমানা পুনর্নির্ধারণের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে রাখার পক্ষে
❌ একাত্তর ও ২০২৪ সালের গণ-আন্দোলনের তুলনার বিরোধিতা
❌ রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের বিরোধিতা
❌ নির্বাচন কমিশনকে সংসদীয় কমিটির অধীন করার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান
❌ এনআইডি কার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়ার বিরোধিতা