বাংলাদেশে এবারের ঈদুল ফিতর উদযাপিত হচ্ছে ভিন্ন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায়, যেখানে পুরনো ও নতুন রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় থাকলেও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে রয়েছেন। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনীতিতে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে মতভেদ ক্রমেই স্পষ্ট হয়েছে। রমজান মাসজুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইফতার আয়োজনে একে অপরের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যও উঠে এসেছে।
নির্বাচন ও রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশল
ঈদের পর দেশে জাতীয় নির্বাচন এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কার ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিএনপি (BNP) শুরু থেকেই দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে এবং তারা ঈদের পর এ বিষয়ে আরও সক্রিয় হওয়ার পরিকল্পনা করছে। দলটি প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাবে বলে জানিয়েছে।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) নির্বাচনের সময়ের চেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের বিচার এবং রাষ্ট্রীয় সংস্কারের ব্যাপারে সরকারের অবস্থানের প্রতি তারা আস্থা রাখছেন এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সরকারের দেওয়া সময় গ্রহণযোগ্য বলে মনে করছেন।
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) (NCP) রাষ্ট্রীয় সংস্কারের দাবি নিয়ে মাঠে থাকতে চায়। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন জানিয়েছেন, তারা জনগণের কাছে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবেন এবং আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংঘটিত গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে চাপ দেবেন।
নির্বাচনের সময় নির্ধারণে মতভেদ
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি স্বাধীনতা দিবসে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছেন, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তবে, বিএনপি এ বক্তব্যকে অস্পষ্ট এবং ধোঁয়াশাপূর্ণ বলে মনে করছে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তারা চায় একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, যাতে জনগণ তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ পায় এবং একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের মতে, প্রধান উপদেষ্টা একেক সময়ে একেক ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন, যা দলটির মধ্যে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। বিএনপি দাবি করছে, নির্বাচন নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটি নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা দরকার, যাতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর হয়।
রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়ার আশঙ্কা
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি তাদের দাবির পক্ষে জনমত গঠনের জন্য মাঠে থাকবে, তবে তারা এমন কোনো কর্মসূচিতে যাবে না যা রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া কঠিন হতে পারে, কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রয়োজনীয় ঐকমত্য এখনো গঠিত হয়নি।
অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কৌশল অপেক্ষাকৃত সতর্ক। তারা মনে করছে, সময়ের চেয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফলে, বিএনপির মতো সরাসরি আন্দোলনে নামার বদলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করাই তাদের লক্ষ্য।
এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকার এনসিপিকে রাজনৈতিক পরিসর তৈরি করতে সুযোগ দিচ্ছে। যদি সরকার সত্যিই রাজনৈতিক সংস্কারের দিকে এগোয়, তাহলে নির্বাচন আরও পিছিয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
সামনের দিনগুলোর সম্ভাব্য চিত্র
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে বর্তমানে কৌশলগত পার্থক্য থাকলেও, উভয় দলই চায় নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। অন্যদিকে, এনসিপি সরকারকে সংস্কার কার্যক্রমে উৎসাহিত করছে এবং তারা আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন আনার লক্ষ্য স্থির করেছে।
ফলে, ঈদের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়তে পারে, বিশেষ করে বিএনপি যদি তাদের দাবির পক্ষে আরও জোরালো কর্মসূচি দেয়। তবে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
— একটি বিবিসি বিশ্লেষণ