আইএমএফের ঋণের কিস্তি ছাড়ে অনিশ্চিয়তা : সমঝোতা ছাড়াই শেষ হলো সফর

বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) কাছ থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নেওয়া ঋণের প্রথম কিস্তির পর থেকে ধারাবাহিকভাবে সংস্কারমূলক পদক্ষেপ ও শর্ত পালনের অগ্রগতি পর্যালোচনায় পাঁচটি মিশন পাঠিয়েছে সংস্থাটি। তবে সর্বশেষ সফরে—যা ছিল চতুর্থ রিভিউ—এই প্রথমবারের মতো ঋণের অর্থ ছাড়ের বিষয়ে কোনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি দুই পক্ষ। মূল বিরোধ দেখা দিয়েছে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির কৌশল ও বিনিময় হার বাজারনির্ভর করার মতো সংবেদনশীল ইস্যুতে।

চলতি এপ্রিলের ৬ তারিখ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত আইএমএফের উন্নয়ন সামষ্টিক অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ক্রিস পাপাজর্জিও (Chris Papageorgiou)-এর নেতৃত্বে চতুর্থ রিভিউ মিশনটি বাংলাদেশ সফর করে। সফর শেষে সংস্থাটির প্রকাশিত বিবৃতিতে ‘স্টাফ লেভেল’ সমঝোতার কোনো উল্লেখ না থাকায় বিষয়টি নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এর আগে প্রতিটি মিশনের পরপরই সমঝোতা সম্পাদিত হতো।

মিশনের বিবৃতিতে ক্রিস পাপাজর্জিও বলেন, “তৃতীয় ও চতুর্থ রিভিউ সম্পন্নের জন্য চলতি এপ্রিলে ওয়াশিংটন ডিসিতে বসন্তকালীন সভার সময় আরও আলোচনা হবে। বাংলাদেশ ও তার জনগণের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি আমরা পুনর্ব্যক্ত করছি।”

চাপের মুখে অর্থনীতি, নীতিতে চাই দৃঢ়তা

বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পাপাজর্জিও বলেন, “বিশ্বব্যাপী অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলাদেশ বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.১ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৩.৩ শতাংশ। মূল্যস্ফীতিও উদ্বেগজনক—গত জুলাইয়ে যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ১১.৭ শতাংশে পৌঁছেছিল, এখন তা কিছুটা কমে ৯.৪ শতাংশ হলেও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।”

এই প্রেক্ষাপটে তিনি নীতিগত কঠোরতা বজায় রাখার ওপর জোর দেন। কর সুবিধা প্রত্যাহার, কর ব্যবস্থার সরলীকরণ, এবং বাজারভিত্তিক বিনিময় হারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন তিনি। তাঁর মতে, এসব পদক্ষেপ রফতানিকে প্রতিযোগিতামূলক করবে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াবে এবং বাহ্যিক চাপ মোকাবেলায় সহায়ক হবে।

কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া গতি নেই

সংস্থাটির মতে, বাংলাদেশে কর আদায়ের হার অর্থনীতির আকারের তুলনায় অত্যন্ত কম। কর ব্যবস্থা হতে হবে স্বচ্ছ, যুক্তিসঙ্গত ও দক্ষ। এর মানে কর অব্যাহতি কমিয়ে আদায় বাড়াতে হবে এবং কর নীতি ও ব্যবস্থাপনাকে পৃথক করতে হবে। এছাড়া ব্যাংক খাত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথাও জোর দিয়ে বলেন তিনি। দুর্বল ব্যাংকগুলোর পুনর্গঠন ও আমানতকারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য নতুন আইন ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়।

অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করতে সুশাসন ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, “এটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করবে, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়াবে এবং তৈরি পোশাক খাতের বাইরেও রফতানি খাত সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে।”

এখনো দরকষাকষি চলছে, সিদ্ধান্ত জুনে

সফরের সময় অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, অর্থ বিভাগের সচিব ড. খায়েরুজ্জামান মজুমদার এবং এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খানের সঙ্গে বৈঠক করেছে আইএমএফ। আলোচনা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, বিপিডিবি, বিইআরসি, পেট্রোবাংলা, ও বিপিসিসহ একাধিক সংস্থার সঙ্গে।

বিশেষত রাজস্ব সংগ্রহে দুর্বলতা এবং বিনিময় হারের অব্যবস্থাপনা নিয়ে এই সফরে আইএমএফ বেশ কঠোর অবস্থান নেয়। ফলে ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থছাড় ঝুলে গেছে। সংস্থাটির পরবর্তী সিদ্ধান্ত আসবে জুনে অনুষ্ঠিতব্য আইএমএফ বোর্ড সভায়।

এই অবস্থায়, ঋণ কর্মসূচির কঠিন শর্ত—বিশেষ করে রাজস্ব আহরণ ও বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করার প্রশ্নে—উচ্চপর্যায়ের আলোচনা এখন সময়ের দাবি। এজন্য আগামী কয়েক দিনের মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসিতে বসন্তকালীন সভায় অংশ নিতে অর্থ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারিতে আইএমএফের নির্বাহী বোর্ড বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ অনুমোদন করে। সাত কিস্তিতে ৪২ মাসে এই ঋণ পরিশোধযোগ্য, যার মেয়াদ চলবে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। এই সময়সীমায় সরকারকে নির্ধারিত শর্ত ও কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *