সংবিধান সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দিনভর বৈঠকে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করল বিএনপি। রাষ্ট্রের মূলনীতি ও সংবিধানের ভিত্তি পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে দলটি বলেছে, তারা পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থানে ফিরে যেতে চায়—যেখানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র পরিবর্তে ছিল ‘আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’।
বিএনপি (BNP) পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে, সংবিধানের যে মৌলিক রূপ পরিবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন, তাতে তারা একমত নয়। গতকাল বৃহস্পতিবার এই আলোচনা হয় কমিশনের সঙ্গে। আলোচনায় অংশ নেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, নজরুল ইসলাম খান, উপদেষ্টা ইসমাঈল জবিউল্লাহ, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং সাবেক সচিব মনিরুজ্জামান খান।
কমিশনের পক্ষে বৈঠকে ছিলেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান ও সফর রাজ হোসেন। বৈঠক সঞ্চালনায় ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার সহকারী মনির হায়দার।
আলোচনার শুরুতে আলী রীয়াজ বলেন, দেশে বারবার গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে, এমনকি এক পর্যায়ে ব্যক্তিতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বাস্তবতায় একটি স্থায়ী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করাই কমিশনের উদ্দেশ্য।
বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার—স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত এই তিন মূলনীতি—রাষ্ট্রীয় নীতিতে সংযোজনের প্রস্তাব নিয়েও দলের মধ্যে আলোচনা চলছে। সালাহউদ্দিন বলেন, “কিছু প্রস্তাব নিয়ে আমরা দলীয়ভাবে আলোচনা করে জানাব।”
বৈঠকে আরও আলোচনা হয় সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাব নিয়ে। বিএনপি নীতিগতভাবে দ্বিকক্ষ সংসদের পক্ষে হলেও কমিশনের প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতির (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষ নির্বাচন) সঙ্গে একমত নয় দলটি। একইভাবে, চার বছরের সংসদ মেয়াদ, সংরক্ষিত নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি এবং মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত বেশ কিছু সুপারিশেও বিএনপির ভিন্নমত রয়েছে।
বিএনপি বলছে, সংবিধান সংশোধন শুধু জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সময়েই করা উচিত। দলটি একমত নয় একই ব্যক্তির একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা এবং একই সঙ্গে দলীয় প্রধান ও সরকারপ্রধান হওয়ার নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব নিয়েও।
গণভোট প্রসঙ্গে বিএনপি বলেছে, সব বিষয়ের জন্য গণভোটের প্রয়োজন নেই; কেবলমাত্র রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির পরিবর্তন হলে সে ক্ষেত্রে গণভোট হতে পারে।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনায় বিএনপি বলেছে, সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠন বা বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া সংবিধান অনুযায়ী হওয়া জরুরি। ৯৫ ও ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন না করে এসব পরিবর্তন করা অসাংবিধানিক হবে।
আলোচনার একপর্যায়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, “বিএনপি সংস্কারের বিরুদ্ধে নয়, বরং আমরাই সংস্কারের পক্ষের দল। তবে জনগণের সম্মতিতে সবকিছু হওয়া উচিত।”
অন্যদিকে, সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের পক্ষে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami), তরুণদের সংগঠন জাতীয় নাগরিক কমিটি (National Citizens’ Platform) এবং চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। জামায়াতের আমির শফিকুর রহমান নির্বাচন আয়োজনের আগে ‘দৃশ্যমান সংস্কার’কে শর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও মৌলিক সংস্কার ছাড়া নির্বাচনের বিপক্ষে।
বিএনপি সূত্র বলছে, বৈঠকে এক-তৃতীয়াংশ বিষয়েই আলোচনা হয়েছে। বাকিগুলোর জন্য রোববার আবারও বৈঠক হবে। সালাহউদ্দিন আহমদ জানান, “মৌলিক বিষয়ে আমরা অনড়, তবে কিছু বিষয়ে দলের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”