জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে গঠিত ১১টি প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সংস্কার কমিশনের মধ্যে আটটির সুপারিশ ইতিমধ্যে জমা দেওয়া হয়েছে। এই সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়াও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। তবে দলগুলোর মতামতের মধ্যে যেমন পরস্পর বিরোধিতা দেখা গেছে, তেমনি কোনো কোনো বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানও নিয়েছে দলগুলো। এই মতপার্থক্য দূর করে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য কাজ করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission), যার নেতৃত্বে রয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus)।
আলোচনার অগ্রগতি ও মতপার্থক্য
কমিশনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে মতামত প্রদানকারী দলগুলো। কয়েক দিনের মধ্যে প্রথম ধাপের আলোচনা শেষ করার লক্ষ্য নিয়েছে কমিশন। যদিও বিশ্লেষকরা বলছেন, দলীয় স্বার্থ ও নির্বাচনী হিসাবের কারণে এক জায়গায় আসা কঠিন হবে। বিএনপি (BNP), জামায়াতে ইসলামী, ও অন্যান্য প্রধান দলগুলোর অবস্থান সংবিধান সংস্কার, নির্বাচন ব্যবস্থা, এবং রাষ্ট্রের কাঠামো নিয়ে একে অপরের থেকে ভিন্ন।
নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি (National Citizens’ Party – NCP), যেটি জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, সংবিধান পুনর্গঠনের পক্ষে এবং গণপরিষদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এই প্রস্তাবে একমত নয় বিএনপি ও জামায়াত।
সংবিধানের মূলনীতি ও ভিন্নমত
সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’-কে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু বিএনপি সংবিধানের ৮, ৯, ১০ ও ১২ অনুচ্ছেদকে পঞ্চদশ সংশোধনীর আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিতে চায়। তাদের মতে, পঞ্চম সংশোধনীতে থাকা “সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” ফিরিয়ে আনাই যুক্তিযুক্ত।
জামায়াতও বহুত্ববাদ নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। তারা সংবিধানে ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের বিষয় অন্তর্ভুক্তির পক্ষে। অন্যদিকে এনসিপি মূলনীতিতে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দিয়ে বহুত্ববাদ, গণতন্ত্র এবং মানবিক মর্যাদার ওপর জোর দিচ্ছে। তবে রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের কমিশনের প্রস্তাবে তারা আপত্তি জানিয়েছে, যেখানে প্রস্তাব করা হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ এর পরিবর্তে ‘নাগরিকতন্ত্র’ বা ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’। জামায়াত ও বিএনপিও রাষ্ট্রের নাম পরিবর্তনের বিপক্ষে। ব্যতিক্রমভাবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ‘বাংলাদেশ জনকল্যাণ রাষ্ট্র’ নামের প্রস্তাব দিয়েছে।
সংসদ ও নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে মতভেদ
সংসদের মেয়াদ চার বছর করার প্রস্তাবে দলগুলোর সায় নেই। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি কমিশনের প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, অর্থবিল ছাড়া অন্য যেকোনো বিষয়ে এমপিরা নিজ দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন। বর্তমান সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে এমন ভোটে এমপিদের আসন শূন্য হয়ে যাওয়ার বিধান রয়েছে।
সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার প্রস্তাবে কিছুটা ঐকমত্য থাকলেও উচ্চকক্ষ ও নারী আসনের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নাগরিক ঐক্য দ্বিকক্ষ সংসদেরই বিরোধিতা করেছে, কারণ দেশে ফেডারেল কাঠামো নেই।
জরুরি অবস্থা ও সাংবিধানিক কমিশন
সংবিধানে প্রস্তাবিত জাতীয় সাংবিধানিক কমিশন (এনসিসি)-এর সিদ্ধান্তক্রমে রাষ্ট্রপতির জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতার প্রস্তাবেও আপত্তি জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও গণসংহতি আন্দোলন। তাদের মতে, এটি সরকারের নির্বাহী কর্তৃত্ব খর্ব করে।
নির্বাচনের আগেই সংস্কার না নির্বাচন–এ নিয়ে দ্বিধা
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে—একটি গোষ্ঠী জরুরি সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচন চায় (যেমন বিএনপি), আরেকটি গোষ্ঠী সরকারকে সময় দিতে চায় (যেমন জামায়াত ও এনসিপি)। বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতির মাঠে পুরনো চিত্র আবার ফিরে আসছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ (Awami League) আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য রয়েছে।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। কিন্তু পুরো ঐকমত্য ছাড়া নির্বাচন আয়োজন এবং স্থায়ী সংস্কার বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়েই এখন প্রশ্ন।