অন্তর্বর্তী সরকারের আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ঘোষণা নিয়ে আশাবাদ ও আশঙ্কা একসঙ্গে জানালেন আবদুল্লাহ সায়ীদ

আন্তর্জাতিক অপরাধ, গোষ্ঠীগত সহিংসতা ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসের অভিযোগে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হওয়ার আগে দলটির সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে অন্তর্বর্তী সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটিকে যুগান্তকারী বলে অভিহিত করেছেন সমাজকর্মী ও আইনজীবী সায়ীদ আবদুল্লাহ (Abdullah Sayeed)। তবে একই সঙ্গে তিনি সতর্ক করেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা যদি কেবল এক্সিকিউটিভ আদেশেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু না হয়, তাহলে সেটি হবে ফাঁকা প্রদর্শন, যার ফল হবে মারাত্মক।

একটি দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টে সায়ীদ লেখেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। তার মিনিং হলো লিগের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার ‘বিচারিক প্রক্রিয়া’র ওপর ছেড়ে দেওয়া হলো।”

তিনি জানান, এই ঘোষণার পর অনেককে অতিমাত্রায় উৎসব করতে দেখা গেছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। সায়ীদের ভাষায়, “প্রকৃত পদক্ষেপ নিতে এখনও বহু রাস্তা হাঁটতে হবে। কারণ বিচারিক কাজ করাটাই হলো মূল দায়িত্ব।”

তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, “আমি খুবই খুশি হব যদি এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার লিগকে নিষিদ্ধ করার জন্য বিচারিক প্রক্রিয়া যথাযথভাবে পালন করে। বিচারিক প্রক্রিয়াটা খুবই টেকনিক্যাল জিনিস। লিগ প্রশ্ন ডিল করার ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়ার পক্ষেই সবসময় বলে এসেছি আমি, এখনও বলছি, ভবিষ্যতেও বলবো।”

তবে তিনি অভিযোগ করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনমূলক কাজে আগ্রহ যেমন দেখা যায়নি, তেমনি কঠিন ও বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের তৎপরতাও তেমন একটা দেখা যায়নি। “সত্যিকারের কাজে ইন্সট্যান্ট হাততালি কম পাওয়া যায়, কিন্তু লংটার্মে খুবই ইফেক্টিভ হয়,” বলেন তিনি।

এক্সিকিউটিভ সিদ্ধান্তের পেছনে থাকা রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে সায়ীদ বলেন, “যদি দেখি মানুষের ইমোশনকে ধরে রাখার জন্য জাস্ট এক্সিকিউটিভ অর্ডারে লিগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে রাখা হলো, কিন্তু বিচারিক কাজটাকে ঠিকমতো এবং দ্রুততার সাথে ও যথাযথ প্রক্রিয়া (কোন ফরমায়েশি সিস্টেমে না) অনুসরণ করে করা হলো না বা করার ক্ষেত্রে গাফিলতি দেখিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো, তাহলে তা হবে—যাহা লাউ তাহাই কদু টাইপ ব্যাপার।”

তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, “সন্ত্রাস বিরোধী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ (Anti-Terrorism (Amendment) Ordinance, 2025)” অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে দলটির কেবল প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রমই নয়, বরং তাদের অনলাইন প্রচার-প্রচারণা বা উস্কানির বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

আবদুল্লাহ সায়ীদ এরপর স্মরণ করিয়ে দেন ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি ঘটনা—“উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অফিসিয়াল একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল এই মর্মে যে, বিচার শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত দলীয় কার্যক্রম চালাতে পারবে না আওয়ামী লীগ।” অর্থাৎ এখন যে সিদ্ধান্তটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হয়েছে, সেটির মূলনীতি আগে থেকেই ছিল।

আরেকটি ঘটনাও তিনি তুলে ধরেন—যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের মাধ্যমে সংগঠন হিসেবে কোন দলকে বিচার করার বিধান যুক্ত করা হয়েছিল। তিনি জানান, “সেই সময় ইন্টেরিম গভমেন্টে প্রথম ওই আইনের সংশোধনী ড্রাফট করেছিলো, তখনই রাখা হয়েছিলো এই প্রভিশন। পরবর্তীতে প্রফেসর ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদ বৈঠকে ‘দল নিষিদ্ধ করা’র বিধান বাদ দেওয়া হয় ২০২৪ সালের নভেম্বরের ২০ তারিখে।” এই সিদ্ধান্তের তিনি তখন থেকেই সমালোচনা করে আসছেন। তাই দেরিতে হলেও এখন তা সংশোধন করে ফেরত আনা হয়েছে—এটি তাঁর কাছে ইতিবাচক।

তবে তিনি আবারো জোর দিয়ে বলেন, “এই আইনগুলো করা শেষ। এখন বিচারিক প্রক্রিয়া পুরোদমে শুরু করা উচিত।” যদি আইন করেও লিগের অনলাইন বা মাঠপর্যায়ের সদস্যরা সাবোটেজ চালাতে থাকে এবং সরকার তা থামাতে না পারে, তাহলে সেটি সরকারের অযোগ্যতার প্রমাণ হবে বলে মন্তব্য করেন সায়ীদ।

“আর লিগ যদি কোথাও প্র্যাকটিক্যালি সাবোটেজ করে বেড়ায়, এখন সেটাও ডিল করার পুরো দায়িত্ব কিন্তু সরকারেরই,” বলেন তিনি। এরপর তিনি সরাসরি মন্তব্য করেন, “আমি চাই না সরকার শুধু আইন করার জন্য আইন করে বসে থাকুক, ওদিকে সরকারের অদক্ষতা এবং অগ্রহণযোগ্য কর্মকাণ্ডের জন্য লিগ অপকর্ম করতেই থাকুক।”

তাঁর মতে, এইভাবে চলতে থাকলে আইন ও অন্যান্য পদক্ষেপ—সবই ব্যর্থ হবে। যদি বিচারিক প্রক্রিয়ায় শক্তভাবে না ঢোকা যায়, তাহলে “লিগ খুব সিরিয়াস লেভেলে আস্কারা পেয়ে যাবে। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্যাপাসিটির সর্ব্বোচ্চ শক্তি তো টেস্টেড হয়ে যাবে, ওটাই সরকারের সর্ব্বোচ্চ ক্যাপাসিটি!” ফলে দলের পক্ষ থেকে তখন বলা হবে—“তোমরা কচুটাও করতে পারলা না!”

পোস্টের শেষে তিনি বলেন, “তাই এসব আইন সংশোধনের কাজ দেখেই অতিরিক্ত খুশি হয়ে খোঁজখবর রাখা ছেড়ে দিয়েন না। মূল কাজ কিন্তু এখনও বাকী। বিচারিক প্রক্রিয়া ঠিকমতো চালু হচ্ছে কিনা কিংবা চালু হওয়ার পর ঠিকঠাক চলছে কিনা—সেই ব্যাপারে সিরিয়াস খোঁজখবর রাখাটা অত্যন্ত জরুরি।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *