বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপি এমন এক জটিল অবস্থানে রয়েছে, যেখানে প্রতিটি সম্ভাব্য কৌশলের মধ্যেই রয়েছে বিপদের সম্ভাবনা। একদিকে অতীতের বিতর্কিত রাজনৈতিক মিত্র জামায়াত—যাদের সঙ্গে আবারও হাত মেলানো মানে হবে আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণভাবে সমালোচনার ঝড় আমন্ত্রণ জানানো; অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ—যাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও অভিযোগের পর তাদের জন্য “স্পেস” তৈরি করা রাজনৈতিক আত্মঘাতের শামিল হতে পারে। এ যেন সত্যিই “সামনে পাহাড়, পেছনে সমুদ্র”।
এই অস্বাভাবিক ও অনিশ্চিত রাজনৈতিক বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছে মূলত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অস্পষ্ট ভূমিকা ও নীতির কারণে। সরকারপ্রধানের কথায়-বার্তায় একটি নির্বাচনমুখী সরকার থাকলেও কার্যত সবকিছু চলছে ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রণেই। এতে করে রাজনৈতিক দলগুলো যেমন দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছে, তেমনি সাধারণ জনগণের মধ্যেও তৈরি হয়েছে এক ধরনের রাজনৈতিক অবসাদ ও হতাশা।
এর সাথে যুক্ত হয়েছে ছাত্র সমাজের একাংশের বিচ্ছিন্ন ও নিত্য-নতুন দাবি। কখনো কোটা সংস্কার, কখনো গরিব শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফ, কখনো খাদ্যদ্রব্যের দাম কমানো, আবার কখনো ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করো’—এমন দাবিও সামনে আসছে। এসব দাবি ন্যায্য বা যুক্তিযুক্ত হোক বা না হোক, আন্দোলনের সময় ও পদ্ধতি মাঝে মাঝে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অস্থিরতা তৈরি করছে, যার ফলে বৃহত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশল নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিএনপির জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো—কোন পথে তারা যাবে? আদর্শকে আঁকড়ে ধরে যদি তারা জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক থেকে দূরে থাকে, তবে তাদের জনভিত্তি গড়তে আরও সময় লাগবে। আবার আওয়ামী লীগকে কিছুটা ছাড় দিয়ে একটি কার্যকর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিলে, তারা নিজেদের আন্দোলনের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে ফেলবে।
এই সংকটের জন্য শুধু বিএনপি দায়ী নয়। দায়ী দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে প্রতিপক্ষকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়ার মানসিকতা কাজ করে, সহাবস্থান নয়। দায়ী সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামো, যা আদতে একটি শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের বদলে তৈরি করেছে দ্বিধা ও ভীতির পরিবেশ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আজ একান্তভাবে প্রয়োজন একটি সত্যিকার অর্থে উদার, গণতান্ত্রিক ও সমঝোতাভিত্তিক সংস্কৃতি—যেখানে রাজনৈতিক মতভেদ থাকবে, কিন্তু প্রতিহিংসার রাজনীতি থাকবে না। এই মুহূর্তে বিএনপির সামনে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ: জনগণের সঙ্গে একটি সাহসী, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য সংলাপে নামা।
বিএনপির প্রয়োজন এমন একটি নেতৃত্ব—যা সাহসী, দূরদর্শী ও নৈতিক। এই নেতৃত্ব গড়ে উঠবে অন্ধ সমর্থনের ওপর নয়, বরং জনগণের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে। শুধু ক্ষমতার জন্য নয়, বরং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য যারা লড়বে—এমন নেতৃত্বই এখন জরুরি।
তবে এই পথচলায় গণতন্ত্রের পক্ষে থাকা সব শক্তির সহযোগিতা অত্যন্ত প্রয়োজন। বিএনপি-ই পারে এই মুহূর্তে দেশকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে। এই বাস্তবতা নতুন রাজনৈতিক শক্তিগুলোকেও মেনে নিতে হবে, এবং সেই অনুযায়ী তাদেরও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে হবে হাতে হাত রেখে, সম্মিলিত প্রয়াসে। সবাইকে শুধু মেনে নিলেই হবে, মনেও নিতে হবে “গণতন্ত্রেই মুক্তি”।
— ডাঃ ফেরদৌস কবির