আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নজিরবিহীন অভিযানে জব্দ করা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র আট মাসে ঢাকার আদালত দুদকের আবেদনের ভিত্তিতে ৭৪টি জব্দের আদেশ দিয়েছেন। এসব আদেশে ১৯২ একর জমি, ২৮টি ভবন, ৩৮টি ফ্ল্যাট, ১৫টি প্লট, ২৩টি গাড়ি ও তিনটি জাহাজ জব্দ করা হয়েছে—যার মধ্যে দেশি ও বিদেশি সম্পত্তি উভয়ই অন্তর্ভুক্ত।
দুদক সূত্র জানায়, ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ (Awami League) ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরই সংস্থাটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়। আগের সময়ে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে, দুদকের কার্যক্রম ছিল সীমিত এবং পক্ষপাতমূলক বলেই অভিযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বা যাঁদের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হতো, তাঁদের বিরুদ্ধেই তৎপর হতো কমিশন।
সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহ এবং কমিশনাররা (মো. জহুরুল হক ও মোছা. আছিয়া খাতুন) ২৯ অক্টোবর পদত্যাগ করেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তাঁরা স্বল্পকালিক কিছু তৎপরতা দেখালেও, তা যে লোকদেখানো ছিল, এমন মন্তব্যও এসেছে দুদকের অভ্যন্তর থেকে।
নতুন নেতৃত্বে গতি পায় অভিযান
১০ ডিসেম্বর জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ আবদুল মোমেন দুদকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেন। কমিশনার হিসেবে যোগ দেন মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাফিজ আহ্সান ফরিদ। নতুন নেতৃত্বের অধীনে দুদক নিয়মিতভাবে জব্দের আবেদন জানাতে শুরু করে এবং আদালতও একের পর এক আদেশ দেন।
জব্দ হওয়া সম্পদের একটি সমন্বিত তালিকা দুদকের কাছে না থাকলেও, বিভিন্ন আদালতের আদেশ এবং সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, এই তালিকায় রাজনৈতিক পরিবার ও সাবেক মন্ত্রীদের নাম রয়েছে।
শেখ পরিবারের সম্পত্তি জব্দ
গত ৩০ এপ্রিল আদালতের এক আদেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় (Sajeeb Wazed Joy), মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, তাঁর মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের জমি ও প্লট জব্দ করা হয়।
সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন তাজুল ইসলাম, নসরুল হামিদ, এনামুর রহমান, জুনাইদ আহ্মেদ পলক, মির্জা আজম, জাকির হোসেন ও জান্নাত আরা হেনরী। শেখ হাসিনার সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সম্পদও জব্দের আওতায় এসেছে।
অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সম্পদ জব্দ
গত ১৬ এপ্রিল একটি আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স সভায় জানানো হয়, শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের বিদেশে থাকা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার শেয়ার এবং চার হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের ব্যাংক হিসাব আদালতের আদেশে জব্দ করা হয়েছে। ৮৪ জন ব্যক্তির বিদেশ গমনেও নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
সরকারি কর্মকর্তার ঘুষে তৈরি বাড়ি
জব্দ হওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে অন্যতম রাজউক (RAJUK)–এর সাবেক সহকারী পরিচালক মো. শামসুল আলম মিলকী। তিনি রাজধানীর উত্তরায় ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে আটতলা বাড়ি নির্মাণ করেন বলে অভিযোগ। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক জানান প্রতি মাসে আড়াই লাখ টাকা ভাড়া ওঠে, যা দুদক কর্মকর্তাদের হস্তান্তর করা হয়।
আন্তর্জাতিক সম্পদ জব্দে চ্যালেঞ্জ
দুদকের একাধিক পরিচালক জানান, অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদের প্রমাণ পাওয়া মাত্রই আদালতের কাছে জব্দের আবেদন জানানো হয়, যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তি সেগুলো বিক্রি করতে না পারেন। তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র দাখিল ও বিচার শেষে আদালতের নির্দেশে এসব সম্পদ রাষ্ট্রীয়ভাবে বাজেয়াপ্ত করা হয়। তবে বিদেশে থাকা সম্পদের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়া দীর্ঘ ও জটিল।
টিআইবি (Transparency International Bangladesh)–এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দুদককে অবশ্যই ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নিতে হবে।” তিনি আরও বলেন, বাজেয়াপ্ত হওয়া সম্পদের ১০ শতাংশ কমিশনকে প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে, যা কমিশনের কার্যক্রমে উৎসাহ যোগাবে এবং একটি তহবিল গঠনে সহায়ক হবে।