নির্বাচন নিয়ে সরকারের নীরবতয় ক্ষুব্ধ বিএনপি, দলের ভিতরেই বাড়ছে চাপ, অসন্তোষ

জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ক্রমেই দ্বিধা ও অসন্তোষে ভরে উঠছে বিএনপি (BNP)। বেশ কিছুদিন ধরেই তারা সরকারের কাছে নির্বাচনের নির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। বরং সরকার ঘনিষ্ঠ কয়েকটি মহল বিএনপি’র এই দাবিকে নেতিবাচক প্রচারণার অংশ হিসেবে উপস্থাপন করছে, যা দলটির হাইকমান্ডের মধ্যে প্রবল অসন্তোষ তৈরি করেছে।

এক দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাম্প্রতিক এক বৈঠকে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘যেন নির্বাচন চাওয়া একটা অপরাধ হয়ে গেছে।’ বিএনপি’র অভিমত, সরকার নির্বাচন বিষয়ে আগ্রহ না দেখিয়ে ইঙ্গিত দিচ্ছে—তারা হয়তো ক্ষমতা দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখার পরিকল্পনা করছে। দলটির শীর্ষ নেতারা মনে করেন, এই দ্বিধা ও সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তোলা হচ্ছে।

বিএনপি হুঁশিয়ার করে বলেছে, ভোট বিলম্বিত করার কোনো উদ্যোগ মেনে নেওয়া হবে না। এমন কোনো উদ্যোগের ইঙ্গিত পেলেই দলটি কর্মসূচির পথে হাঁটবে, এবং এতে তাদের সঙ্গে থাকবে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোও। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির আসন্ন বৈঠকে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অন্যদিকে, গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম শরিক দল এনসিপি (NCP) সংস্কার বাস্তবায়নের পর নির্বাচনের পক্ষে। নবগঠিত এই ছাত্রভিত্তিক দলটি নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য সময় চায়। তবে জামায়াতের অবস্থান এখনো অস্পষ্ট—তারা কখনও বলছে সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হয়নি, আবার কখনও নির্বাচন নিয়ে ইতিবাচক কথা বলছে। এই দ্বৈত অবস্থানকেও ভিন্নভাবে দেখছে বিএনপি।

গত শনিবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান (Tarique Rahman) নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, “পরিস্থিতি অযথা ঘোলাটে না করে জাতীয় নির্বাচনের সুস্পষ্ট তারিখ ঘোষণা করুন। জনগণের ভোটে দায়বদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠা না হলে পলাতক স্বৈরাচারকে মোকাবিলা করা যাবে না।”

দলটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনের বিষয়ে এতদিন ধৈর্য ধারণের পরও সরকারের অবস্থান তাদের হতাশ করেছে। এখন দলের ভেতর থেকেই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটছে। অনেক নেতাকর্মীর মনে হচ্ছে সরকারকে চূড়ান্ত বার্তা না দিলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে পড়বে।

এই প্রেক্ষাপটে রমজানের আগেই দেশজুড়ে সভা-সমাবেশ কর্মসূচির মাধ্যমে রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানায় বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (Amir Khasru Mahmud Chowdhury) বলেন, “নির্বাচন যত বিলম্বিত হচ্ছে, দেশ ততই অস্থিরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকার যেন নিজেকে একটি নির্বাচিত সরকার মনে করছে, অথচ এটি কেবল একটি অন্তর্বর্তী সরকার, যার দায়িত্ব নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।”

অন্য সদস্য বেগম সেলিমা রহমান (Selima Rahman) বলেন, “বিএনপি তো কর্মসূচিতেই আছে। প্রতিটি ইস্যুতেই আমরা সভা-সমাবেশ করছি।”

বিএনপি মনে করে, একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া ‘পলাতক স্বৈরাচার’ হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগীদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। অন্তর্বর্তী সরকার বরং পরিস্থিতিকে অকারণ জটিল করে তুলছে। দলটির নেতারা এটিও বিশ্বাস করেন যে, সরকারের মধ্যে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার প্রবণতা ও লোভ স্পষ্ট।

এক শীর্ষ বিএনপি নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “ফ্যাসিস্ট দোসরদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত যদি কেউ ভোট না চায়, তাহলে কি বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন বন্ধ থাকবে? সরকার কি সে দাবি মেনে নেবে? যদি বিএনপি এই পরিস্থিতিতে রাজপথে নামে এবং জনগণ রাস্তায় নামে, তখন পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?”

এদিকে, বিএনপি’র যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স (Syed Emran Saleh Prince) বলেন, “আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শুরু থেকেই সমর্থন দিয়েছি। আমরা চাই তারা সফল হোক। কিন্তু এজন্য জরুরি হচ্ছে দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা। সরকার তা না করলে আমরা আর বসে থাকব না।”

রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্রমবর্ধমান চাপ এবং অভ্যন্তরীণ উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে, এখন সবার চোখ সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। তবে বিএনপি আর অপেক্ষা নয়, এবার মাঠে নামার জন্য প্রস্তুত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *