দেশজুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘিরে তীব্র আলোড়ন তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার তিনি দায়িত্ব ছাড়ার ইচ্ছা উপদেষ্টা পরিষদে জানানোর পর থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে তৎপরতা বেড়েছে বহুগুণ। বিভিন্ন পক্ষ তার পদত্যাগ ঠেকাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কেউ কেউ ভুল স্বীকার করে ভবিষ্যতে সংশোধনের আশ্বাসও দিয়েছেন। তবে ইউনূস নিজে এখনও সিদ্ধান্তে অনড় না নমনীয়—তা স্পষ্ট নয়।
আজ (শুক্রবার) উপদেষ্টাদের সঙ্গে তার এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক নির্ধারিত আছে। সূত্রমতে, এই বৈঠকের ফলেই প্রকাশ্যে আসতে পারে ইউনূসের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত—তিনি দায়িত্বে থাকছেন, না কি নতুন কাউকে দায়িত্ব তুলে দিতে চলেছেন। জানা গেছে, ভেতরে-বাইরে নানা পরামর্শের প্রেক্ষিতে তিনি আপাতত দায়িত্বে থাকার বিষয়ে কিছুটা সম্মত হয়েছেন, তবে নিতে পারেন নতুন কিছু সিদ্ধান্ত। উপদেষ্টা পরিষদে রদবদল, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানোসহ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা ভাবা হচ্ছে।
চলমান সংকট সমাধানে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব এসেছে একাধিক পক্ষ থেকে। এমনকি একটি দল সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বানও জানিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, দুই এক দিনের মধ্যে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে পারেন ড. ইউনূস।
দুর্বল সংযোগ, পক্ষপাতের অভিযোগ
এই সংকটের মূল উৎস হিসেবে দেখা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দুর্বল সংযোগকে। নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizen Party) বা এনসিপি’র সঙ্গে সরকারের ঘনিষ্ঠতা এবং অন্যান্য দলগুলোর প্রতি অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। এনসিপির প্রতি পক্ষপাতের অভিযোগ বিশেষ করে তোলা হয়েছে বিএনপি ও জামায়াতের পক্ষ থেকে। চার দিন ধরে বিএনপি প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎ চাইলেও তা সম্ভব হয়নি।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, ড. ইউনূস একটি ‘অশুভ চক্রে’ ঘেরাও হয়ে আছেন। সরকারের ভেতরের চারজন এবং বাইরের তিনজন এই চক্রে সক্রিয়, যারা নাকি চায় না নির্বাচন হোক। এই চক্রই ইউনূসকে জনবিচ্ছিন্ন করে তোলার চেষ্টা করছে।
আন্তঃদলীয় চাপ ও উপদেষ্টাদের বিতর্ক
ঐকমত্য কমিশনের (Consensus Commission) ভাইস চেয়ারম্যান ড. আলী রীয়াজ বৃহস্পতিবার ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে করণীয় ঠিক করতে ইউনূস তাকে ডেকে পাঠান এবং দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পরামর্শ নেন। সেই সময় সাম্প্রতিক ঘটনা ও ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশদ আলোচনা হয়।
সরকারের ভেতরের সূত্র জানায়, দু’জন ছাত্র উপদেষ্টাকে ঘিরে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিএনপিসহ একাধিক দল তাদের অপসারণ দাবি করেছে। তাদের উপস্থিতি সরকারের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা প্রতিনিধিদেরও এখন কোণঠাসা অবস্থায় ফেলেছে এই পরিস্থিতি। একইসঙ্গে এনসিপি নেতারা যমুনায় গিয়েও ইউনূসকে দায়িত্ব চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানান। তবে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালন কঠিন, যদিও জাতিকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে চান।
ফয়েজ আহমদের ফেসবুক পোস্ট: অস্বস্তি ও বার্তা
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব (Fayez Ahmad Tayyeb) এক ফেসবুক পোস্টে দাবি করেন, ইউনূস পদত্যাগ করবেন না বলেই তিনি বিশ্বাস করেন। কিছু সময় পর তিনি ওই পোস্ট মুছে ফেললেও তা ইতিমধ্যে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে। ওই পোস্টে ইউনূসের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে তিনি লেখেন, “স্যারের ক্ষমতা প্রয়োজন নেই, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য দরকার আছে।”
তিনি আরও লেখেন, সরকারের আরও ফাংশনাল হওয়া দরকার, দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখাতে হবে জনতার সামনে, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ প্রয়োজন।
সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান (Waqar-uz-Zaman)-এর নির্বাচনী মন্তব্য নিয়েও ফয়েজ মন্তব্য করেন—তিনি ‘জুরিশডিকশনাল কারেক্টনেস’ রক্ষা করতে পারেননি। একই পোস্টে তিনি নির্বাচন এপ্রিলে বা মে মাসে হতে পারে বলেও মত দেন, যদিও এটি তার ব্যক্তিগত অভিমত বলে পরে ‘ডিসক্লেইমার’ দিয়ে জানিয়ে দেন।
জাতীয় ঐক্য, না বিভাজন?
রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ আলোচনা তীব্রতর হয়েছে ইউনূসের পদত্যাগের খবর প্রকাশের পর। জামায়াত সর্বদলীয় বৈঠকের আহ্বান জানায়, ইসলামী আন্দোলন বৈঠক করে সমমনাদের সঙ্গে। বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দুটি বৈঠকের তথ্যও মিলেছে। দুই দলের মধ্যে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে বিএনপি এখনো জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবে আগ্রহ দেখায়নি।
সবশেষে, ইউনূসের পদত্যাগ মানেই কি সংকটের অবসান? রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, না। বরং পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। ইউনূস যদি সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত না নেন, তাহলে ‘বিপ্লবের চেতনা’ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।