২০১৫ সালের গোড়ার দিকের এক সকালে যখন বিএনপির মুখপাত্র সালাহউদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ হন, তখন অনেকেই আন্দাজ করেছিলেন—এটি ছিল একটি পরিকল্পিত অপহরণ। কিন্তু এই ঘটনার পেছনের সাহস, গোপন প্রতিরোধ আর লেখনীর তীক্ষ্ণ শক্তির গল্পটি আজ ভুলে যেতে বসেছে অনেকে। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম (Shafiqul Alam) তার ফেসবুক পোস্টে সেই ইতিহাসের এক মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেছেন।
সালাহউদ্দিন আহমেদ যখন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে অপহরণের শিকার হন এবং সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে পাঠানো হয়, তার আগে তিনি একটি গোপন স্থান থেকে বিএনপির মুখপাত্রের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। সেই সময় আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপির ওপর কঠোর দমননীতি চালাচ্ছিল। খালেদা জিয়া (Khaleda Zia) গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গৃহবন্দি, শীর্ষ নেতারা কেউ গ্রেফতার, কেউ আত্মগোপনে।
এই দমন-নির্যাতনের সময়ে ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা এএফপি-র দক্ষিণ এশিয়া প্রধান ক্রিস অটন (Chris Otton) ও শফিকুল আলম গোপনে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে প্রবেশ করেন, ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট গিবসনের সঙ্গে। সাধারণ পোশাকে থাকা নিরাপত্তা বাহিনী তাদের ব্রিটিশ হাইকমিশনের প্রতিনিধি ভেবে ঢুকতে দেয়।
সেই সময় প্রতিদিন পাওয়া যেত সালাহউদ্দিন আহমেদের বিবৃতি। শফিকুল আলম বলেন, তারা প্রতিটি প্রতিবেদনেই তার বক্তব্য অন্তর্ভুক্ত করতেন কারণ এগুলো ছিল সুচিন্তিত, প্রভাববিস্তারকারী ও সরল। আগে বিএনপির রুহুল কবির রিজভী ছিলেন দলের অন্যতম প্রাণবন্ত রাজনৈতিক কর্মী, কিন্তু তার বিবৃতিতে ছিল জটিল বাক্য আর দুর্বোধ্য শব্দচয়নের আধিক্য—যা সাংবাদিকদের জন্য ভালো উদ্ধৃতি বের করা কঠিন করে তুলত।
কিন্তু যখন রিজভী গ্রেফতার হন এবং সালাহউদ্দিন দায়িত্ব নেন, তখন শুরু হয় ভাষাগত শক্তির এক নতুন অধ্যায়। গোপন স্থান থেকে পাঠানো বিবৃতিগুলো ছিল বিস্ফোরক, কঠোর ও প্রত্যক্ষ—সরাসরি শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে। এই বিবৃতিগুলোর অভিঘাতে এতটাই আলোড়ন সৃষ্টি হয় যে, নিরাপত্তা সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সালাহউদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন।
অবশেষে, সালাহউদ্দিন একদিন নিখোঁজ হন। কিন্তু তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ চুপ থাকেননি। তিনি অকুতোভয়ে স্বামীর মুক্তির দাবিতে লড়াই চালিয়ে যান। শফিকুল আলম বলেন, এই লড়াই ছিল ‘মায়ের ডাক’ আন্দোলনের হাজেরা খাতুন ও তার মেয়েদের মতোই সাহসী ও নির্ভীক। বলা হয়ে থাকে, এই দাবির তীব্রতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার কারণেই সালাহউদ্দিনকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের শিলংয়ে পাঠানো হয়।
তবে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে সামাজিক মাধ্যমে কুৎসা রটানো হয়, যা শফিকুল আলমের মতে অত্যন্ত দুঃখজনক। এমনকি বিএনপির অনেক তরুণ কর্মী, যারা দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন, তারাও ভুলে গেছেন দলের সেই বীরত্বগাথা ইতিহাস। এই লড়াইয়ের স্মৃতি যেন আজ চাপা পড়ে গেছে রাজনৈতিক আরামদায়ক সময়ের আড়ালে।
শফিকুল আলম শেষ পর্যন্ত মনে করিয়ে দেন—এই স্মৃতিগুলো ভুলে গেলে চলবে না। কারণ, এই অধ্যায়গুলোই ছিল শেখ হাসিনার দমননীতির সবচেয়ে নির্মম সময়ের বিরুদ্ধে সাহসী প্রতিবাদ।