বাংলাদেশ এক কঠিন সময় পার করছে। সচিবালয়ে কার্যক্রম স্থবির, নগর ভবন অবরুদ্ধ, শেয়ারবাজারে ধস, আর এসবের মাঝেই দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে। এই ক্রান্তিকালে রাজধানী যেন গোটা দেশের উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্বে বহাল থাকার ঘোষণাটি অনেকের কাছেই নাটকীয় ও বিতর্কিত বলে মনে হয়েছে। সাম্প্রতিক নানা সিদ্ধান্ত ও বিবৃতি, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর ভূমিকা, নির্বাচন, ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের অবস্থান—সমগ্র পরিস্থিতিকে করেছে আরও জটিল।
২০২৪ সালের আগস্টে যখন এই সরকারের যাত্রা শুরু হয়, তখন অনেকেই আশা করেছিলেন তারা একটি স্বচ্ছ রোডম্যাপ নির্ধারণ করে রাজনৈতিক সংস্কার, বিচার প্রক্রিয়া ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করবে। কিন্তু সময়ের সাথে সেই প্রত্যাশা ম্লান হয়েছে। বিশেষ করে বিএনপি (BNP) এবং জামায়াতে ইসলামি (Jamaat-e-Islami) সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।
সরকারের অভ্যন্তরীণ নানা বিতর্ক, যেমন মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে অস্পষ্টতা, চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় বিদেশিদের অন্তর্ভুক্তি, এবং সেনাপ্রধানের বক্তব্য ঘিরে বিভ্রান্তি—সব মিলিয়ে জনগণের আস্থার সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
সেনাবাহিনীর তরফে বলা হয়েছে ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। এটি একটি সময়সীমার ইঙ্গিত দিলেও, সরকারের পক্ষ থেকে এসবকে ব্যক্তি মতামত হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এ ধরনের মনোভাব রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর অস্বাভাবিক আগ্রহকে প্রকাশ করে, যা উপদেষ্টা পরিষদের প্রতি আস্থার সংকট আরও গভীর করেছে।
উপদেষ্টাদের নিয়োগ ও কার্যপরিধিতে পক্ষপাতিত্ব ও আস্থার অভাব কাজ করছে শুরু থেকেই। কিছু উপদেষ্টা বিএনপি ও ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখার অভিযোগে অভিযুক্ত। অনেকেই মনে করছেন, এতে সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। উপদেষ্টা পরিষদের একাধিক সদস্য সরকারের কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে বলেও প্রকাশ্যে অভিযোগ করেছেন।
সব মিলিয়ে পরিষ্কার যে সরকার সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোনো ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে না। যেমন না হচ্ছে সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন, তেমনই নেই নির্বাচনী রোডম্যাপের কোনো নির্দিষ্টতা। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
একদিকে সেনাবাহিনীকে কেউ কেউ সাধুবাদ জানাচ্ছেন, অন্যদিকে অনেকে বলছেন, সিভিল বিষয়ে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। তবে এমন প্রশ্নও উঠছে, যদি সেনাবাহিনী আগস্টে হস্তক্ষেপ না করত, তবে ২০২৪ সালের শুরুতে প্রথম কোন সফল পদক্ষেপ আদৌ নেওয়া যেত কি না।
সেনাবাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, কার্যত একমাত্র ক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়ে গেছে তারা। দেশের অন্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো কার্যত অচল।
অনেকেই মনে করছেন, সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে নেতিবাচকভাবে দেখা বা তা নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক মনোভাব রাখা গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এমন এক সময়ে বিতর্কিত উপদেষ্টাদের নিয়ে বিতর্ক আরও চরমে উঠেছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা পদত্যাগ করবেন না, তবে অভ্যন্তরীণভাবে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ইঙ্গিত মিলেছে।
সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যদি কোনো গোষ্ঠী বা বিদেশি চাপে দায়িত্ব পালন অসম্ভব হয়ে ওঠে, তবে তারা দায়িত্ব ছাড়বে—এটি কার্যত একটি সতর্কবার্তা।
তবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের সংলাপ শুধুই আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ থাকলে, রাজনৈতিক সঙ্কট কাটবে না। উপদেষ্টাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য ও ভুল ব্যাখ্যা এখন একটি গুরুতর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার যদি সত্যিই দায়িত্বশীল হতে চায়, তবে এই ধরনের আচরণ থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।
রাজনৈতিক পর্যালোচনায় পরিষ্কার চারটি বড় ব্যর্থতা—নির্বাচন, বিচার, সংস্কার ও উপদেষ্টা পরিষদের পক্ষপাত—সরকারকে গভীর সংকটে ফেলেছে। তবুও এখনো আশা করা যাচ্ছে, সরকার যদি দ্রুত এবং বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করে, বিচার ও সংস্কারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আন্তরিক সংলাপ শুরু করে, তবে এই অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
আন্তর্জাতিকভাবে এই সংকট নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র (USA) সক্রিয়ভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করছে। তারা স্পষ্টভাবে বলছে, যদি নির্বাচনী গণতন্ত্র না থাকে, তবে দেশের অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়বে।
এই মুহূর্তে দেশের প্রধান জাতীয় চাহিদা কেবল একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র কাঠামোর দিকে দৃঢ় অঙ্গীকার।