সাংবিধানিক সংস্কারে অমীমাংসিত বহু প্রশ্ন, তবে আলোচনা এগোচ্ছে: আলী রীয়াজ

সাংবিধানিক সংস্কার নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম পর্যায়ের আলোচনার পরেও অনেক মৌলিক বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো পূর্ণ ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি। সোমবার (২৬ মে) জাতীয় সংসদের এলডি হলে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ (Ali Riaz)।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ ও মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন, এক ব্যক্তি কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, একজন সাংসদের একাধিক পদে থাকা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং সংবিধান সংশোধনের পদ্ধতিসহ বেশ কিছু গঠনমূলক বিষয়ের ব্যাপারে এখনো মতভেদ রয়েছে।

আলী রীয়াজ জানান, “এই সব মৌলিক কাঠামোগত বিষয়ের ব্যাপারে দ্বিতীয় পর্বে বিস্তারিত আলোচনা হবে। শিগগিরই সেই আলোচনা শুরু হবে এবং জুলাইয়ের মধ্যেই জাতীয় সনদের খসড়া প্রস্তুত করা সম্ভব হবে বলে আমরা আশাবাদী।”

যেসব প্রস্তাবে আংশিক বা নীতিগত ঐকমত্য

সংবিধান সংস্কার নিয়ে গঠিত পাঁচটি সুপারিশ কমিশনের বেশ কিছু প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নীতিগত ঐকমত্য তৈরি হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি নিয়ে কোনও দল আপত্তি করেনি।

রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার এবং গণতন্ত্র’ অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে একধরনের ঐকমত্য থাকলেও ‘বহুত্ববাদ’ শব্দটি বাদ রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন বেশিরভাগ দল।

এ ছাড়া, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠনের প্রস্তাবেও বেশিরভাগ দল একমত। উচ্চকক্ষে ১০০ সদস্য রাখার বিষয়ে একমত হলেও, তাদের নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে এখনও মতভেদ রয়ে গেছে। নিম্নকক্ষে নারীদের জন্য ১০০ আসন সংরক্ষণের ব্যাপারে সমর্থন থাকলেও, সেটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে বিভক্তি আছে।

নির্বাচন ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক সংস্কার

বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, বিচারপতি এমদাদুল হকসহ অন্যান্য কমিশন সদস্যরাও সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এবং জানান, নির্বাচন কমিশনের জন্য পূর্ণাঙ্গ আইন প্রণয়ন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের কাছে হস্তান্তর এবং রাষ্ট্রপতির জন্য যোগ্য, সৎ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তির মনোনয়নের বিষয়ে অধিকাংশ দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে।

একটি স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কর্তৃপক্ষ গঠনের বিষয়েও বেশিরভাগ দল একমত হয়েছে, যদিও কৌশলগত দিকগুলোতে মতানৈক্য রয়েছে।

সংবিধান সংশোধনের সুপারিশগুলোর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হলো— নির্বাচন কমিশনের আর্থিক, প্রশাসনিক ও আইনি প্রস্তাবনা যেন সংসদের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষের স্পিকারের নেতৃত্বাধীন একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটির কাছে উপস্থাপিত হয়। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র।

মানবতাবিরোধী অপরাধ ও প্রাদেশিক শাসন নিয়ে মতভেদ

মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখার জন্য মানবতাবিরোধী (ট্রাইব্যুনাল) আইন ও আরপিও সংশোধনের প্রস্তাবেও দলগুলোর ভিন্নমত রয়েছে। বেশিরভাগ দল এর আইনি দিককে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে বলেছে।

প্রাদেশিক শাসনব্যবস্থা চালু, পুরোনো চারটি বিভাগের ভিত্তিতে প্রদেশ গঠন, জেলা পরিষদ বিলুপ্তি এবং উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদ তুলে দেওয়ার প্রস্তাবে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল একমত হয়নি। পৌরসভায় চেয়ারম্যান নির্বাচন ওয়ার্ড মেম্বারদের ভোটে করার বিষয়েও একমত হওয়া যায়নি।

দ্বিতীয় পর্বে বাড়তি প্রত্যাশা

অধ্যাপক আলী রীয়াজের মতে, “নীতিগত ঐকমত্যের ভিত্তিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, তবে কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলোতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া অগ্রগতি সম্ভব নয়।”

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের লক্ষ্য, জুলাই মাসের মধ্যে একটি কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় সনদের খসড়া তৈরি করে তা দেশের সামনে উপস্থাপন করা। সেই লক্ষ্যে আগামী মাসেই দ্বিতীয় দফা আলোচনা শুরু হবে বলে জানান তিনি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *