আন্দোলনে অচল প্রশাসন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যেই শিক্ষকদের যোগ বিক্ষোভে

বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও সরকারি খাতজুড়ে অসন্তোষের আবহে এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে যোগ দিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। সোমবার (২৬ মে) থেকে তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘ছুটি’ ঘোষণার মাধ্যমে এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন।

এই ঘটনা ঘটে এমন এক সময়ে, যখন ৮৪ বছর বয়সী মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে পড়েছে—ছাত্র আন্দোলন, রাজনৈতিক দলের দাবি, সামরিক বাহিনীর হুঁশিয়ারি ও প্রশাসনিক অসন্তোষ একত্রে বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে।

প্রসঙ্গত, গত আগস্টে ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন, যখন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) ছাত্র-আন্দোলনের মুখে ভারত চলে যান। এরপর থেকেই দেশে অস্থায়ী শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে—যদিও বাস্তবে নানা প্রতিবন্ধকতা তার সামনে।

অবস্থার আরও উত্তপ্ত রূপ নেয় রোববার (২৫ মে), যখন সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করে জানায়—জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় দীর্ঘ প্রক্রিয়া ছাড়াই অসদাচরণের অভিযোগে সরকারি কর্মচারীদের বরখাস্ত করতে পারবে। এই সিদ্ধান্ত আমলাতন্ত্রজুড়ে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে এবং সোমবার সরকারি কর্মচারীরা টানা তৃতীয় দিনের মতো বিক্ষোভে অংশ নেন।

এই পরিস্থিতিতে প্রাথমিক শিক্ষকদের আন্দোলন সরকারের জন্য এক নতুন সংকট বয়ে আনছে। হাজার হাজার শিক্ষক ছুটিতে গিয়ে দাবি জানাচ্ছেন—অধ্যাদেশ প্রত্যাহার ও ন্যায্য বেতনবৃদ্ধি।

এর আগে, একই রকম চাপের মুখে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুটি বিভাগ গঠনের পরিকল্পনা বাতিল করতে বাধ্য হয়, কর্মীদের বিক্ষোভের মুখে। এরপর এনবিআর কর্মীরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করেন।

রাজনৈতিক অঙ্গনেও উত্তেজনা চরমে। ছাত্রনেতাদের বক্তব্য, আমলাতন্ত্রের অসন্তোষ এবং সেনাবাহিনীর পরোক্ষ হস্তক্ষেপ—সব মিলিয়ে ইউনূসের নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখে। এমন প্রেক্ষাপটে ইউনূস সম্প্রতি বলেছেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন ও সংস্কারের রূপরেখায় একমত হতে না পারে, তবে তিনি পদত্যাগ করতে পারেন। তবে তার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ (Wahiduddin Mahmud) সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “আমাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোথাও যাচ্ছি না।”

সংকটময় এই পরিস্থিতিতে ইউনূসের প্রশাসন দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের আহ্বানে আটকে আছে। ইউনূস জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হতে পারে। তবে বিরোধী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) (BNP) ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের দাবিতে অনড়। বিএনপির পাশে রয়েছে জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) এবং ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি।

অন্যদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান (Waqar Uz Zaman) সম্প্রতি এক ভাষণে ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান, যা রাজনৈতিক চাপ আরও বাড়িয়েছে।

এই পরিস্থিতি বিবেচনায় ইউনূস শনিবার তার উপদেষ্টা পরিষদের জরুরি বৈঠক ডাকেন এবং একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেন। তার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানান, “আমরা যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে আছি… আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার পর নানা পক্ষ থেকে অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা চলছে।”

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ (Awami League)-এর নিবন্ধন এই মাসেই স্থগিত হওয়ায় দলটি পরবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না, যা দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্যে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

এই রাজনৈতিক দোলাচলের মধ্যে শিক্ষক, আমলা ও সাধারণ কর্মচারীদের বিক্ষোভে বাংলাদেশ এখন এক গভীর প্রশাসনিক অচলাবস্থার সামনে দাঁড়িয়ে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *