গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে সংঘাতের পথে এগিয়ে ক্রমবর্ধমান চাপ ও অনিশ্চয়তায় ইউনূস

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বদানকারী নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus) এখন ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চাপের মুখে। নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, অর্থনৈতিক মন্দা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং সংস্কার কার্যক্রমে দৃশ্যমান অগ্রগতির ঘাটতি—সব মিলিয়ে জনঅসন্তোষ বাড়ছে। এমন উত্তপ্ত প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী, ব্যবসায়িক মহল এবং বিএনপি (BNP) সকলে আগাম নির্বাচনের দাবি তুলছে, যা ইউনূসের অবস্থানকে আরও নড়বড়ে করে তুলেছে।

এই পরিস্থিতি ঘিরে মার্কিন সাময়িকী Foreign Policy-তে দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশ্লেষক মাইকেল কুগলম্যান তাঁর মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছেন, ২০২৪ সালের আগস্টে গণআন্দোলনের চাপে শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে আসেন। তবে শুরু থেকেই তাঁর কাজ ছিল কঠিন: জনতার চাপে পুনর্গঠন ও গণতন্ত্রের প্রত্যাশা, আর দীর্ঘ দমন-পীড়নের প্রেক্ষাপটে বড়সড় চ্যালেঞ্জ।

প্রথমদিকে তরুণদের মধ্যে ইউনূসের প্রতি প্রবল শ্রদ্ধা থাকলেও এখন সেই ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে। কুগলম্যান লিখেছেন, এই সরকার এখনও কোনো নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে পারেনি, অথচ সংস্কার কার্যক্রমে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে, যার রাজনৈতিক ভিত্তি প্রায় নেই বললেই চলে। সরকার বলছে, নির্বাচন ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে অনুষ্ঠিত হবে।

পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে উল্লেখ করে কুগলম্যান লিখেছেন, ইউনূসের নেতৃত্বাধীন একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বাংলাদেশি জনগণ ক্রমাগত অধৈর্য হয়ে উঠছে, যার কোনো গণভিত্তি নেই, যা এখন পর্যন্ত নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করেনি এবং দৃশ্যমান অগ্রগতির অভাব সত্ত্বেও ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে চলছে।

ড. ইউনূস’র পদত্যাগের গুঞ্জন নিয়ে eকুগলম্যান লিখেছেন, জুলাই আন্দোলনের শীর্ষ নেতা, শিক্ষার্থী পরিচালিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) প্রধান এবং অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম জানান, যদিও ড. ইউনূস এখনও পদত্যাগ করেননি। তবে, এই হুমকিটি সম্ভবত ইউনুসের একটি কৌশল হতে পারে—পরিস্থিতির গুরুত্ব বোঝাতে তাঁর চারপাশের মানুষদের সতর্ক করার জন্য।

দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক এই বিশ্লেষকের মতে, ইউনূস এখন গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সঙ্গে সংঘাতের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি ছাত্রনেতাদের সিদ্ধান্তে সমর্থন দিয়েছেন এবং তাঁদের নীতিগত অবস্থানকেও সমর্থন করেছেন। আর তাঁরা নির্বাচনের সময় পেছালেও সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিএনপি, ব্যবসায়ী মহল এবং সম্ভবত বেশির ভাগ সাধারণ জনগণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচনের পক্ষে। এই ক্রমবর্ধমান জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নতুন বিভাজনরেখা তৈরি হতে পারে। আগাম নির্বাচনের দাবিতে থাকা বিএনপির সঙ্গে এখন এনসিপি এবং প্রভাবশালী ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামীর মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর সঙ্গে দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে। নানা মতাদর্শী দল যখন নিজেদের দাবি নিয়ে রাজপথে নামে, তখন রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা সত্যিই বেড়ে যায়।

অন্যদিকে দেশে ক্রমাগত খারাপ খবর আসছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে কোভিড-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে কম। সহিংস অপরাধ বেড়েছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে।

এই সংকটের মধ্যেই ২১ মে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান (Gen. Waqar Uz Zaman) নির্বাচন শেষ করার সর্বোচ্চ সময়সীমা হিসেবে ডিসেম্বরের কথা বলেন। একই দিনে বিএনপি প্রথমবারের মতো এই অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামে। এমন আগাম নির্বাচনের দাবি তারা আগেও তুলেছে, তবে এবার তা আরও জোরালো।

কুগলম্যানের বিশ্লেষণে একটি দিক অনুপস্থিত, যা এখন দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত দুটি ইস্যু: রাখাইন সংকটে মানবিক সহায়তা করিডোর এবং বিদেশি ব্যবস্থাপনায় বন্দর পরিচালনার প্রস্তাব। রাখাইনে মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে জাতিসংঘের প্রস্তাব নিয়ে প্রথম মুখ খোলেন প্রধান উপদেষ্টার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। এরপর প্রেস সচিব এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানও এ বিষয়ে কথা বলেন। কিন্তু বিষয়টি রাজনৈতিক মহল, বিশ্লেষক এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ায়।

এই বিভ্রান্তির আবহে বন্দর ব্যবস্থাপনা প্রশ্নে একধরনের অস্পষ্টতা তৈরি হয়, যা নিয়ে বামপন্থী দল থেকে শুরু করে বিএনপি পর্যন্ত উদ্বেগ প্রকাশ করে। প্রশ্ন ওঠে: অন্তর্বর্তী সরকারের কি আদৌ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ম্যান্ডেট আছে?

এই পরিস্থিতিতেই আসে একটি নতুন মোড়—নাহিদ ইসলাম (Nahid Islam), এনসিপি নেতা ও সরকারের সাবেক তথ্য উপদেষ্টা, বিদেশি সংবাদমাধ্যমে জানান, ড. ইউনূস পদত্যাগের কথা ভাবছেন। যদিও তা এখনও আনুষ্ঠানিক নয়, কুগলম্যানের বিশ্লেষণে উঠে আসে—এটি ইউনূসের একটি কৌশলও হতে পারে, আশেপাশের শক্তিগুলোকে সতর্ক করার জন্য।

এই রাজনৈতিক অস্থিরতায় নতুন বিভাজনের ইঙ্গিতও স্পষ্ট। বিএনপির মতো প্রভাবশালী দল আগাম নির্বাচনের পক্ষে রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। মতাদর্শিক বিভেদ থাকা সত্ত্বেও রাজপথে সমবেত হওয়া, রাজনৈতিক সহিংসতার আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

কুগলম্যান লিখেছেন, সেনাবাহিনী এখনো সরকারবিরোধী অবস্থানে যায়নি, তবে তাদের নির্বাচনী সময়সীমা নিয়ে মন্তব্য ‘তাৎপর্যপূর্ণ’। বিশেষ করে, জেনারেল ওয়াকার ইলন মাস্কের স্টারলিংক পরিষেবা বন্ধে সরকারের সিদ্ধান্তেরও বিরোধিতা করেছেন, যা তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে।

অন্যদিকে, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে শত্রুতা আরও বেড়েছে। আওয়ামী লীগের দুর্নীতির দায় শেখ হাসিনা অস্বীকার করায় বাংলাদেশের অনেক মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে, যা হয়ত অন্তর্বর্তী সরকারের আওয়ামী লীগকে নির্বাচন থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে প্রভাব ফেলেছে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব বিদেশে পালিয়ে গেছে। কিন্তু দলের যে অংশ এখনো রয়ে গেছে, তারা এই সিদ্ধান্ত ভালোভাবে নেয়নি।

সব মিলিয়ে, রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে হচ্ছে। কুগলম্যান আশঙ্কা প্রকাশ করে লিখেছেন, এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি সহিংসতায় রূপ নিতে পারে এবং সেনাবাহিনী কি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসবে—সেই প্রশ্নও উঁকি দিচ্ছে।

তবে তিনি সম্ভাব্য একটি আশার আলোক রেখার কথাও বলেছেন। তাঁর মতে, একটি শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের জন্য সেরা পথ হতে পারে—অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে মূল সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাবে, বাস্তবায়নের জন্য সময়সূচি নির্ধারণ করবে এবং নির্বাচনের দিন ঘোষণা করবে। কিছু রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যেই কিছু বিষয়ে একমত হতে শুরু করেছে, যা ইউনূসের জন্য সম্ভাব্য এক মর্যাদাপূর্ণ প্রস্থান পথ তৈরি করতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *