বাংলাদেশে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে বিস্তৃত মন্তব্য করেছেন ওবায়দুল কাদের (Obaidul Quader)। তবে তিনি যেখানে দুর্নীতির কিছু অভিযোগ স্বীকার করেছেন, সেখানে গুম, নিখোঁজ ও নির্বাচনী অনিয়ম নিয়ে তাঁর জবাব ছিল বেশ কৌশলী ও পরোক্ষ। রবিবার ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে এই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেতার মন্তব্যগুলো উঠে আসে।
সাক্ষাৎকারে কাদের দাবি করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে আসলে একটি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন। তাঁর কথায়, “এই দিনক্ষণ ঘোষণার মধ্যেই ভোট না-হওয়ার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল। যদি আওয়ামী লীগ ছাড়া নির্বাচন হয়, তা দেশ-বিদেশ কোথাও গ্রহণযোগ্য হবে না। আর জোর করে নির্বাচন হলে, তা শুধু আওয়ামী লীগহীন নয়, মুক্তিযোদ্ধাবিহীন পার্লামেন্ট হবে।”
কোটা আন্দোলনকে সরকার পতনের ষড়যন্ত্র বললেন কাদের
জুলাই-আগস্টে অনুষ্ঠিত ছাত্র আন্দোলন প্রসঙ্গে কাদের স্বীকার করেন, আওয়ামী লীগ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে এর পরিণতি আন্দাজ করতে পারেনি। ‘প্রথমে কোটা-বিরোধী মনে হলেও পরে তা এক দফা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়’, মন্তব্য তাঁর। তিনি আরও বলেন, ‘তখন গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল বটে, তবে আন্দোলন সরকার পতনে গিয়ে ঠেকবে—এমনটা আমাদের অনেকেই ভাবতে পারেননি।’
চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করে তিনি বলেন, আন্দোলনে লস্কর-ই-তইবা (Lashkar-e-Taiba)-র একটি শাখা জড়িত ছিল এবং পাকিস্তানঘেঁষা উগ্রপন্থার সমর্থনও পেয়েছিল। ‘ছাত্র সমাজের একটি আবেগপ্রবণ অংশ ওই সময় জঙ্গিদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল’, জানান তিনি।
তবে গুলিতে মৃত্যুবরণকারীদের বিষয়ে দলীয় কোনো স্বচ্ছ ব্যাখ্যা দিতে পারেননি কাদের। বরং তিনি আন্দোলনকে ‘হুজুগে পরিস্থিতি’ এবং ‘সমাজবিরোধী অপশক্তি ও লুটেরা শ্রেণির চক্রান্ত’ বলে আখ্যা দেন। তাঁর বক্তব্য, ‘এরা ৭১-এর পরাজিত শক্তি, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল।’
ক্ষমার প্রশ্নে দ্বৈত মনোভাব, কিন্তু জবাব দেশের মাটিতে
আন্দোলন দমনে পুলিশের সহিংস ভূমিকায় আওয়ামী লীগ ক্ষমা চাইবে কিনা—এই প্রশ্নে কাদের বলেন, “যদি কোনো ভুল করে থাকি, তাহলে জনগণের কাছে ভুল স্বীকার করা হবে। তবে সেটা দেশের মাটিতে থেকেই করব।” অর্থাৎ, আন্তর্জাতিক চাপ বা বিদেশে বসে এ বিষয়ে মন্তব্য করতে তিনি রাজি নন।
নেতারা দেশ ছাড়েননি, কর্মীরাই এখন নেতা
বর্তমানে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা বিদেশে পালিয়েছেন এমন অভিযোগও উড়িয়ে দেন কাদের। তাঁর দাবি, “আমরা সবাই দেশ ছাড়িনি। অধিকাংশ নেতা এখনো দেশে, কেউ কেউ আত্মগোপনে থেকে দলকে ধরে রেখেছেন। কর্মীরাই এখন নেতা হয়ে গিয়েছেন।”
তবে স্বীকার করেন, আইনজীবীদের উপর দমন-পীড়নের কারণে কারাবন্দি কর্মীদের পাশে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়েছে। “৮৭ জন আইনজীবী একদিনে গ্রেফতার হয়েছেন, তবুও যতটা পারি আইনি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি,” বলেন তিনি।
ইউনূসকে ‘ক্ষমতালোভী’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধবিরোধী’ বললেন কাদের
কাদেরের ভাষায়, দেশের এই অরাজকতার জন্য সরাসরি দায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁকে আখ্যা দেন ‘ক্ষমতালোভী’ ও ‘উগ্রবাদী উত্থানের মূল নেতা’। এমনকি, ইউনূসের অতীত আচরণ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি—“৫ আগস্টের আগে কখনও শহিদ মিনারে যাননি, স্মৃতিসৌধেও না। মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মানসিকতা সেখান থেকেই স্পষ্ট।”
দুর্নীতির অভিযোগে বারবার বিদ্ধ হয়ে আসা শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষে কিছুটা আত্মসমালোচনাও করেন কাদের। তিনি বলেন, “আমাদের সময় দুর্নীতি হয়নি, তা বলব না। তবে দুর্নীতি করলে সাজা হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, আমাদের মন্ত্রী-সাংসদরাও শাস্তি পেয়েছেন।”
তবে গ্রামীণ ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাকে নিয়ে ইউনূসকে নিশানা করে বলেন, “এই ব্যাংকের নামে মানুষ ঘরছাড়া, জেলবন্দি, আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছে। এমন লোক দেশের নেতৃত্ব দিতে পারেন না।”
গুম, নিখোঁজ ও নির্বাচনের প্রহসন—নীরবতা বজায়
তবে সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্নগুলোর একটি—আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুম, নিখোঁজ এবং নির্বাচনের প্রহসন—এসব বিষয়ে সরাসরি কোনো জবাব দেননি ওবায়দুল কাদের। বরং ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসার অভিযোগ তুলে বলেন, ‘তিনি বঙ্গবন্ধুর ছবি টাকায় রাখেননি, এখানেই তাঁর মানসিকতা স্পষ্ট।’