‘পাঁচ বছর পাঁচ বছর’ স্লোগানের নাটক? ইউনূসের পাশেই দেখা মিললো সেই ছোটনের

“স্যার পাঁচ বছর, পাঁচ বছর”—এই স্লোগানটি ঘিরে বাংলাদেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। দৃশ্যত মঞ্চনাটকের মতো সাজানো এই প্রচারণা ছিল সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের একটি প্রয়াস, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিক ও তার সহযোগী ছোটন গং। তবে শুধু একটি স্লোগান বা একটি ভিডিও নয়, এর পেছনে রয়েছে বহুস্তর বিশিষ্ট এক রাজনৈতিক নকশা—যার কুশীলব হিসেবে উঠে এসেছে এক রহস্যময় নাম: নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন (Nurul Islam Bhuiyan Choton)।

সরকারের নিরাপত্তা বিধিমালা অনুযায়ী, প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা বেষ্টনীর আশেপাশে কারা থাকতে পারবে, তার একটি নির্দিষ্ট তালিকা থাকে। তবুও এই কাঠামো ভেঙে কীভাবে ‘পাঁচ বছর পাঁচ বছর’ ধ্বনি উঠল, এবং তার ভিডিও করে তা প্রচার করলেন শফিক—তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সরকারের ভেতরে ও বাইরে। আর সেই ভিডিওতেই শফিকের পাশেই দেখা মিলেছে ছোটনের।

ছোটনের নাম নতুন করে আলোচনায় আসার কারণ এই স্লোগান প্রচারের পেছনে তার পরিকল্পক হিসেবে ভূমিকা। তবে তার ইতিহাস অনেক গভীর ও বিতর্কিত। তিনি শুধু শফিকের সহযোদ্ধাই নন, বরং বাংলাদেশের রাজনীতির পেছনের দৃশ্যপটে এক প্রভাবশালী, কৌশলী এবং বিতর্কিত মুখ।

কে এই ছোটন?

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী (Dr. Zafrullah Chowdhury)-র ভায়রা নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (University of Dhaka)-এর ছাত্র থাকাকালীন সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। আশির দশকে এরশাদ (Ershad) সরকারবিরোধী আন্দোলনের সময় শ্রমিক ও কৃষকদের সচিবালয়ে ঢুকিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালানোর জন্য তার নাম উঠে আসে। তখনকার ওয়ার্কার্স পার্টি (Workers’ Party)-র নেতা হিসেবে তিনি ভুল তথ্য ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে তুলেছিলেন।

পরবর্তীতে ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠনের সময় হাওয়া ভবনে ভারতপন্থী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশে তার অবদান ছিল বলে দাবি করা হয়। যদিও আদর্শিকভাবে তিনি ইসলামি মূল্যবোধ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের বিরোধী ছিলেন, তথাপি সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমানের পাশে দাঁড়িয়ে যায়যায়দিন (Jaijaidin) পত্রিকায় সক্রিয় হন এবং পরে ডিজিএফআইয়ের সহায়তায় সেই পত্রিকার নিয়ন্ত্রণ নিতে চেয়েছিলেন।

ওয়ান ইলেভেন থেকে ফরহাদ মজহারের গুম

২০০৬ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতায়, ওয়ান ইলেভেনের সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার হঠাতে ছোটনের গোপন তৎপরতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। সেই সময় খালেদা জিয়ার বক্তৃতা লেখক শফিক রেহমানকে বেআইনিভাবে বিমান থেকে নামানোর পেছনে ছোটনের হাত ছিল বলে অভিযোগ আছে।

২০১৭ সালে আলোচিত কবি ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারের (Farhad Mazhar) ‘গুম’-এর ঘটনার ক্ষেত্রেও ছোটনের জড়িত থাকার প্রসঙ্গ বারবার উঠে এসেছে। গুমের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তাকে রাজনৈতিকভাবে নিঃসঙ্গ ও প্রান্তিক করে তোলার জন্য একটি পরিকল্পিত প্রচারণা চালানো হয়, যার অন্যতম কুশীলব ছিলেন ছোটন। তার এই ভূমিকাকে অনেকেই রাষ্ট্রীয় শক্তির কৌশলী ব্যবহার হিসেবে দেখেন।

এবি পার্টি, জামায়াত বিভাজন ও চরমোনাই কানেকশন

ছোটনের প্রভাব শুধু ব্যক্তি বা গণমাধ্যম নিয়েই সীমাবদ্ধ নয়; তার ছায়া পড়েছে জামায়াতে ইসলামি (Jamaat-e-Islami)-র মতো শক্ত রাজনৈতিক দল ও তার সংস্কারপন্থী অংশেও। একাধিক রিপোর্টে উঠে এসেছে, কীভাবে জামায়াতের তরুণ ও সংস্কারপন্থীদের আদর্শিক বিভাজনে ছোটন ভূমিকা রেখেছেন। তার প্রভাবেই এবি পার্টির মতো সেক্যুলার ঝোঁকের নতুন দল গড়ে ওঠে, যা কার্যত জামায়াত-বিএনপি জোটকে দুর্বল করার একটি কৌশল ছিল।

অন্যদিকে, চরমোনাই (Charmonai)-এর সঙ্গে ছোটন-মেসবাহ সাঈদ-নূর মোহাম্মদের গ্যাংয়ের সংযোগ, বরিশাল নির্বাচন ঘিরে চরমোনাই প্রার্থীদের প্রচারণা ও জামায়াত-চরমোনাই ঐক্যের ধারণা—সবই ছোটনের মিডিয়া ও রাজনৈতিক প্রভাবের ফলাফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অভ্যন্তরে ‘অন্তর্ঘাত’?

ছোটন ও তার ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন চক্র’ নামে আখ্যায়িত করছে বিশ্লেষকরা। অভিযোগ রয়েছে, এই গোষ্ঠী মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোকে দুর্বল করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেওয়ার কৌশল হাতে নিয়েছে। সি আর আবরার (C.R. Abrar)-কে উপদেষ্টা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং সেনাবাহিনীর স্থিতিশীল নেতৃত্বকে দুর্বল করার অপচেষ্টা—সব কিছুতেই এই গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা স্পষ্ট।

টিকটক ভিডিও, কিন্তু রাজনৈতিক ‘ক্যু’

ফিরে আসা যাক ‘পাঁচ বছর পাঁচ বছর’ স্লোগানে। এই স্লোগান কোনো সাধারণ জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ছিল না—বরং এক অদৃশ্য নাট্যকারের লেখা স্ক্রিপ্ট, যেখানে শফিক ছিলেন ভিডিওগ্রাফার এবং ছোটন ছিলেন কনডাক্টর। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ড. ইউনুস (Dr. Yunus)-কে রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত করে তোলা, যাতে তিনি সরকারের ও বিরোধীদলের উভয় মহলে সমর্থন হারান।

এই ঘটনা প্রমাণ করে, রাজনীতির মাঠে দৃশ্যমান কৌশলের পাশাপাশি, অদৃশ্য শক্তির এক জাল বিস্তৃত হচ্ছে—যেখানে টিকটক ভিডিও, স্লোগান, মিডিয়া হাইপ সবই বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ। আর সেই প্রকল্পের অদৃশ্য পরিচালক হিসেবে নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটনের নাম এখন জনমনে শঙ্কার কারণ হয়ে উঠছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *