“আগে আওয়ামী লীগ আমাকে আক্রমণ করত, এখন সবাই করে”: ড. ইউনূস

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) মনে করেন, এক বছর আগে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক বিপ্লবের পরেও সাধারণ মানুষ এখনো রাষ্ট্রকে ‘শত্রু’ হিসেবেই দেখে।

দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বলেন, ‘মানুষের মনে এখনো সরকারের প্রতি আস্থা ফিরে আসেনি। সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনার একমাত্র উপায়—ঘরে ঘরে, কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত দুর্নীতি নির্মূল করা।’

তিনি বলেন, ‘এখনো সরকারকে একটি শক্তিশালী শত্রু হিসেবে দেখে মানুষ, যাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে সবাই। কোনো না কোনোভাবে মানুষকে সব সময় কিছু অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে টার্গেট করা হচ্ছে। সরকার যেনো সাধারণ মানুষের জীবনে সহায়ক নয়, বরং বাধা।’

২০২৪ সালের গ্রীষ্মে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এরপর থেকেই দায়িত্বে আছেন ইউনূস।

তিনি জানান, তার লক্ষ্য একটি এমন রাষ্ট্র গঠন করা যেখানে জনগণের কল্যাণই হবে রাষ্ট্রের মুখ্য উদ্দেশ্য। বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সেবাগুলোর মান উন্নত করতে হবে—মানুষকে কেবল ভোটের সময় নয়, প্রতিদিনের জীবনে রাষ্ট্রের উপকারিতার ছোঁয়া দিতে হবে।’

বিক্ষোভের পেছনের আসল কারণ

যদিও মূল আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরির কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের ক্ষোভ থেকে, কিন্তু এই ক্ষোভের গভীরে ছিল উচ্চ জীবনযাত্রার ব্যয়, বেকারত্ব ও তরুণদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা।

তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিরুদ্ধে তখন কর্তৃত্ববাদী আচরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ উঠেছিল। ব্যাংক খাত ছিল ভয়াবহ দুর্নীতিতে আক্রান্ত—অভিজাত শ্রেণি বিশাল অঙ্কের ঋণ নিয়েও পরিশোধ করেনি, যার দায় গিয়ে পড়ে সাধারণ জনগণের ওপর।

ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা যখন দায়িত্ব নিই, তখন আমাদের সামনে ছিল এক বিধ্বস্ত অর্থনীতি, ভেঙে পড়া সমাজ ও প্রশাসন। কেউ জানত না পরদিন বিল পরিশোধ করা সম্ভব হবে কিনা। ব্যাংকগুলো ঋণ দিয়েছে, ভালো করেই জানত তারা যে এই টাকা আদায় হবে না। এগুলো উপহার ছিল, ঋণ নয়।’

সংস্কার প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সমঝোতা

বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনী ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন এবং সামাজিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের জন্য একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। ইতোমধ্যে কমিশনগুলোর সুপারিশগুলো প্রস্তুত, যেগুলো নিয়েই এখন তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত গড়তে চাচ্ছেন।

‘জুলাই সনদ’ নামক একটি ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তির আগে চূড়ান্ত করতে চান ইউনূস। তিনি বলেন, ‘এটি কোনো ফাঁপা দলিল নয়, বরং মৌলিক প্রস্তাবনায় পূর্ণ। আমাদের এখন কাজ হলো সেগুলো বাস্তবায়ন করে একটি কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা।’

কিন্তু রাজনৈতিক ঐক্যমত গড়া সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) (Bangladesh Nationalist Party – BNP), যেটি এখন দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী দল, তারা দ্রুত নির্বাচন ও প্রধানমন্ত্রী পদের মেয়াদসীমার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

তবুও ইউনূস আশাবাদী। তিনি বলেন, অতীতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের দৃষ্টান্ত খুবই সীমিত হলেও, এখন যেভাবে দলগুলো আলাপ করছে, তা অনুপ্রেরণাদায়ক।

ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক উদ্যোগের মডেল

ড. ইউনূস রাষ্ট্রের জনসেবামূলক কাজগুলোতে অলাভজনক সামাজিক উদ্যোগগুলোকে উৎসাহিত করতে চান। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা এবং ক্ষুদ্রঋণের প্রসারে তিনি জোর দিচ্ছেন।

বর্তমানে, ক্ষুদ্রঋণ খাত বেশিরভাগই এনজিওদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ইউনূস চান এটি আরও কাঠামোগত হোক—বিশেষায়িত ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

তবে, ক্ষুদ্রঋণ খাত নিয়েও বিতর্ক আছে। কিছু ঋণদাতার উচ্চ সুদের হার এই খাতের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। ইউনূস বলেন, ‘অনেকেই ভাবে ক্ষুদ্রঋণ দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে টাকা লুটে নেয়। কিন্তু এটি আদতে গরিবদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা দেয়। এই মডেলটি আজ বিশ্বের বহু দেশে অনুকরণ করা হচ্ছে।’

তিনি মূলধারার ব্যাংকিং ব্যবস্থার সমালোচনা করে বলেন, ‘এগুলো দরিদ্র মানুষকে ঋণ দিতে চায় না, অথচ বড়লোকরা হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ফেরতই দেয় না।’

উপসংহার: দায়িত্বে থাকলেও বিদায় নিতে প্রস্তুত

মাত্র এক বছর আগেও হাসিনা সরকার ইউনূসকে তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলে রেখেছিল। কিন্তু সেই অবস্থান বদলে এখন তিনি রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দুতে।

তবে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন, নির্বাচনের পর তিনি সরকারে থাকবেন না। বলেন, ‘আগে আওয়ামী লীগ আমাকে আক্রমণ করত, এখন সবাই করে। এটা খুব স্বাভাবিক। আপনি এই চেয়ারে থাকলে আপনাকে সমালোচনা সহ্য করতেই হবে।’

তার আশা, এপ্রিলের নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত সরকার আসবে এবং তখন তিনি বিদায় নেবেন। আর ততদিন পর্যন্ত, সংস্কার এবং ঐক্যমতের পথ ধরে নতুন বাংলাদেশের ভিত গড়ে তোলার কাজেই নিবেদিত থাকবেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *