বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর পদে এক যুগের বেশি সময় থাকা নসরুল হামিদ বিপু (Nasrul Hamid Bipu) আজ আর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নেই—আছেন পলাতক অবস্থায়। আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তার অবৈধ সম্পদের সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে শুরু করেছে। অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার সম্পদ গোপনে বিক্রি করে পাচার করে দিচ্ছেন এই সাবেক মন্ত্রী।
রাজধানীর গুলশান ক্লাবের উল্টো পাশে একটি বিরাট প্লট রয়েছে যার মূল্য বাজারদরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। এটি নসরুল হামিদের মালিকানাধীন, যেটি তিনি গত তিন মাস ধরে বিক্রির চেষ্টা করছেন। পাশাপাশি মাদানি এভিনিউতে ৫ বিঘার আরেকটি জমিও রয়েছে, যেখানে একসময় পরিবার-পরিজন ও ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে আড্ডা দিতেন। প্রতি কাঠা দুই কোটি টাকা ধরে এখানেও জমি বিক্রির উদ্যোগ চলছে, যদিও বড় বিনিয়োগকারীর অভাবে জায়গাটি ছোট ছোট প্লটে ভাগ করে বিক্রির প্রক্রিয়ায় নেমেছে তার কোম্পানি হামিদ রিয়েল এস্টেট (Hamid Real Estate)।
গুলশান, বনানী ও নিকেতন এলাকার একাধিক ছোট সম্পত্তি ইতোমধ্যেই বিক্রি করে ওই অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় পাঠিয়ে দিয়েছেন নসরুল হামিদ। তার দুই সন্তান আগে থেকেই বিদেশে বাস করছেন, আর এসব দেশেই পরিবারসহ বাড়ি-গাড়ি কিনে রেখেছিলেন অনেক আগে।
নসরুল হামিদের পারিবারিক ব্যবসা জমি কেনাবেচা—‘হামিদ গ্রুপ’-এর অধীনে থাকা একাধিক কোম্পানির মাধ্যমে তার এই অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করে। এর মধ্যে রয়েছে হামিদ রিয়েল এস্টেট কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, হামিদ কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট, হামিদ ফ্যাশন, হামিদ সোয়েটার ও হামিদ অ্যাগ্রো লিমিটেড। গ্রুপের মূল আবাসন ব্র্যান্ড ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ’। এমডি হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন বিপুর ভাই ইন্তেখাবুল হামিদ অপু, যিনি এখন পলাতক।
হামিদ রিয়েল এস্টেটের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিপু পরিবারের সম্পদের পরিমাণ অন্তত ৮ হাজার কোটি টাকা। তবে আগস্টের পর থেকেই কোম্পানিগুলোতে ধস নেমেছে—ছাঁটাই করা হয়েছে বহু কর্মী, এবং কেরানীগঞ্জে ‘প্রিয়প্রাঙ্গণ’ প্রকল্পের একাধিক জমি বেদখল হয়ে গেছে।
প্রিয়প্রাঙ্গণ-১ ও ২ নামে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলে হামিদ গ্রুপ। ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশে প্রিয়প্রাঙ্গণ-২ প্রকল্পে এখনও সঠিক রাস্তাঘাট কিংবা অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। নিরাপত্তাও অনুপস্থিত। ক্রেতারা অভিযোগ করছেন—প্লটের টাকা পরিশোধ করেও রেজিস্ট্রেশন পাননি। ২০০৮ সালে কিস্তিতে প্লট কিনে ২০১২ সালে পুরো টাকা পরিশোধ করার পরও এক ক্রেতা, হেমায়েত হোসেন, এখনও জমির মালিকানা পাননি।
এছাড়া, ময়মনসিংহের ত্রিশালে নারায়ণপুর ও খাগাদীপাড়ায় গড়ে তোলা ‘হামিদ ইকোনমিক জোন’-এও রয়েছে জোরপূর্বক জমি দখলের অভিযোগ। ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (BEZA) অঞ্চলটির অনুমোদন দেয়।
কেরানীগঞ্জ এলাকায় স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, বিগত দেড় দশক ধরে কেরানীগঞ্জে কার্যত নসরুল হামিদের কথাই ছিল আইন। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অনেকেই তার দখলে থাকা জমি পুনরুদ্ধার করেছেন, যদিও ইতোমধ্যেই সেসব জমি প্লটে ভাগ করে বিক্রি করে দিয়েছেন বিপু।
সবচেয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ উঠেছে রাজধানীর ঝিলমিল প্রকল্প নিয়ে। রাজউক (RAJUK) জানায়, নসরুল হামিদ ঝিলমিল প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজের শত শত একর জমি দখল করে সেখানে প্রিয়প্রাঙ্গণ আবাসিক এলাকা গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন গণপূর্ত ও গৃহায়নবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সদস্য এবং রিহ্যাব সভাপতি। নীতিমালা পাস আটকে দিয়ে প্রকল্পের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করেন, যাতে নিজের প্রকল্পের জমি ‘আইনি বৈধতা’ পায়।
রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মুহাম্মদ নুরুল হুদাও স্বীকার করেছেন, তাদের নীতিমালা বারবার আটকে দিয়েছিল মন্ত্রণালয়। ফলে রাজউকের সাড়ে ৩ হাজার প্লট ও ৩০ হাজার ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনাও থমকে যায়।
তদন্ত সূত্র বলছে, প্রিয়প্রাঙ্গণ প্রকল্পের পাশাপাশি ‘আলিফিয়া রিভার ভিউ’ নামে একটি নতুন প্রকল্পও গড়ে তুলেছেন নসরুল হামিদ, যা নিবন্ধিত হয়েছে তার মেয়ে আলিফা হামিদের নামে। এখানেও স্বচ্ছ জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি।
নাম, পদ, ক্ষমতা ও পদবি ব্যবহার করে যে বিশাল অবৈধ সম্পদের সাম্রাজ্য গড়ে তোলা হয়েছিল—ছাত্র আন্দোলনের পর সেই সাম্রাজ্যই আজ চোরাগলি দিয়ে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, পেছনে রয়ে যাচ্ছে প্রতারণার গল্প আর ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষ।