রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় করা মামলায় গ্রেপ্তার সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (কে এম নুরুল হুদা) আদালতে দাবি করেছেন, বিতর্কিত নির্বাচন হলে তা কমিশনের দায় নয়। সোমবার বিকেলে আদালতে হাজির হয়ে তিনি বলেন, “নির্বাচন হয়ে গেলে কমিশনের ক্ষমতা শেষ হয়, তখন বিচার করার এখতিয়ার হাইকোর্টের।”
এসময় আদালত তাকে প্রশ্ন করে, “আপনি কি শপথ ভঙ্গ করেছেন?” উত্তরে হুদা বলেন, “না।” তার যুক্তি, ৫ সদস্যের কমিশন এবং ১৬ লাখ সহায়ক কর্মী পুরো দেশের সব প্রান্তে কী ঘটছে, তা ঢাকায় বসে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। শুনানিকালে তিনি আরও বলেন, বিতর্কিত নির্বাচন নিয়ে অভিযোগ থাকলেও, কমিশনের হাতে সব নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা তার বিরুদ্ধে সরাসরি রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তোলেন। চাঞ্চল্যকর বক্তব্যে পাবলিক প্রসিকিউটর দাবি করেন, “ফ্যাসিস্ট হাসিনার ফ্যাসিজমে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন তিনিই। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়েছেন, রাতের ভোট দিয়েছেন, বিরিয়ানি দিয়ে ভোট কিনেছেন।” এমনকি তাকে ‘নিশি রাতের নির্বাচন কমিশনার’ বলেও অভিহিত করা হয়।
রাষ্ট্রপক্ষের এমন বক্তব্যের বিরোধিতা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তৌহিদুল ইসলাম সজিব। তিনি বলেন, “প্রসিকিউশন রিমান্ডের পক্ষে আইনি ব্যাখ্যা না দিয়ে অপ্রাসঙ্গিক ও রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছে। যেসব ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো জামিনযোগ্য। তাহলে কেন রিমান্ড চাওয়া হচ্ছে?” তার বক্তব্যের সময় এজলাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, আইনজীবীদের মধ্যে হট্টগোল হয়।
অন্য এক আইনজীবী জানান, নুরুল হুদা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ৯ নম্বর সেক্টরে সাব-কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার নেতৃত্বে পটুয়াখালী হানাদার মুক্ত হয়। এরপর বিচারক জানতে চান, নুরুল হুদার আর কোনো বক্তব্য আছে কি না। হুদা ফের বলেন, “কমিশন ফেয়ার নির্বাচন আয়োজনের শপথ নেয়, কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পর কমিশনের ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়।”
সাড়ে তিনটা থেকে চারটা পর্যন্ত পক্ষে-বিপক্ষে দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালত আসামিপক্ষের জামিন ও রিমান্ড বাতিলের আবেদন খারিজ করে নুরুল হুদার চার দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এই মামলার সূত্রপাত রোববার (২২ জুন) যখন বিএনপি নেতা মো. সালাহউদ্দিন খান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনা ও সাবেক তিন নির্বাচন কমিশনারসহ মোট ২৪ জনকে আসামি করা হয়। অভিযোগে বলা হয়, ২০০৯ সালে সামরিক শাসকদের সহায়তায় আওয়ামী লীগ অবৈধভাবে ক্ষমতায় আসে এবং এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থাকে বাতিল করে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে মামলায় বলা হয়েছে, নুরুল হুদা কমিশনের প্রধান হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার করে বিরোধী প্রার্থীদের হয়রানি, আক্রমণ, হত্যা ও গুমের ঘটনা ঘটান। দিনভর ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করে রাতেই ভোট নেয়া হয়।
বিএনপি দাবি করে, ঐ নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণভাবে সংবিধানবিরোধীভাবে কাজ করেছে এবং জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেছে। সংবিধানের ৭(এ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের মালিক জনগণ, অথচ এই নির্বাচন ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
মামলায় আরও বলা হয়, ২০২৪ সালের নির্বাচনেও একই কৌশলে আরেকটি বিতর্কিত ভোট আয়োজন করা হয়, যেখানে তৎকালীন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল ছিলেন প্রধান, কিন্তু হুদার “প্রত্যক্ষ মদদে” তা সংঘটিত হয়।
আদালতে দেওয়া তার বক্তব্যে সাবেক সিইসি এ দায় পুরোপুরি অস্বীকার করেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ ও মামলার অভিযোগপত্রে তার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ বলে দাবি করা হয়েছে।