ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মামলা থেকে বাঁচানোর জন্য যোগাযোগ করার কথা স্বীকার করে যা বললেন সাদিক কায়েম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) ছাত্ররাজনীতির সাম্প্রতিক বিতর্ক ফের একবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (Bangladesh Democratic Student Council – BDSC)-এর ঢাবি শাখার আহ্বায়ক আব্দুল কাদের শনিবার (২ আগস্ট) অভিযোগ করেন, “শিবিরের যেসব ছেলেরা গুপ্তভাবে ছাত্রলীগে প্রবেশ করত, তারাই পরে সবচেয়ে বেশি আগ্রাসী হয়ে ওঠে। হলে হলে ছাত্র নির্যাতনে, ‘শিবির ট্যাগ’ দিয়ে নিপীড়নের সামনের কাতারেই ছিল তারাই।”

আব্দুল কাদেরের এই বক্তব্যের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন আরও কয়েকজন সাবেক ছাত্রনেতা, যারা প্রায় সবাই ২০২৪’র গণঅভ্যূথানের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। ।

এরপরদিন রোববার (৩ আগস্ট), কাদের ফেসবুকে একটি স্ক্রিনশট পোস্ট করেন, যার দাবি অনুযায়ী তা ছিল ঢাবি শিবিরের সাবেক সভাপতি সাদিক কায়েমের সঙ্গে হওয়া কথোপকথনের অংশ। ওই স্ক্রিনশটে ছাত্রলীগের হয়ে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত কয়েকজনকে মামলা তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার অনুরোধ করতে দেখা যায়।

তবে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মামলা থেকে বাঁচানোর জন্য যোগাযোগ করার কথা স্বীকার করে সাদিক কায়েম বলেন, “সে সময় অনেকেই বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করে জানান যে, “তারা ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত থাকলেও কোনো ফৌজদারি অপরাধ করেননি এবং ব্যক্তিগত আক্রোশবশত মামলায় তাদের নাম যুক্ত করা হচ্ছে।”
স্বাভাবিকভাবেই গণহারে মামলার আশঙ্কা থাকলে কে অপরাধী আর কে নিরপরাধ—তা যাচাই করার জন্য আন্দোলনে সক্রিয় নানা স্টেকহোল্ডারের কাছে তথ্যগুলো ফরওয়ার্ড করে পারস্পরিক ফিডব্যাকের ভিত্তিতে ভেরিফাই করাটা জরুরি ছিল। তাই বেশ কয়েকটি কনসার্ন বিভিন্ন মাধ্যম থেকে পেয়ে আমি এনসিপি নেতা ও সংস্কার কমিশনের এক সদস্য আরমান হোসেন এবং মাহিনকে ফরওয়ার্ড করি অধিকতর তদন্তের জন্য।”

সাদিক ফেসবুকে হুঁশিয়ারি দিয়ে লেখেন, “স্ক্রিনশট পলিটিক্স শুরু হলে এনসিপি, বাগছাস থেকে যারা দিনরাত শিবির ব্যাশিং করে—তাদের অনেকেরই রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যেতে পারে!” তিনি আরও বলেন, “একজনের সঙ্গে হওয়া ব্যক্তিগত আলাপ কাদের অপব্যাখ্যা করে পাবলিকলি শেয়ার করে নতুন এক ঘৃণার সংস্কৃতি চালু করেছে।”

‘স্ক্রিনশট পলিটিক্স’ ও তথ্য যুদ্ধ

সাদিক কায়েম ব্যাখ্যা করেন, ৫ আগস্টের ঘটনার পর নিরপরাধ কাউকে যেন মামলায় না ফেলা হয়, সেই লক্ষ্যে তথ্য যাচাইয়ের কাজ চলছিল। এনসিপির নেতা আরমান হোসেন এবং সংস্কার কমিশনের সদস্য মাহিনের সঙ্গে কিছু নাম শেয়ার করা হয় যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে। স্ক্রিনশটে যাদের নাম এসেছে, তারা কেউই সেই সময় শিবিরের পদে ছিলেন না বলেও দাবি করেন তিনি।

অন্যদিকে, আব্দুল কাদের নিজের বক্তব্যে বলেন, সাদিক কায়েম সরাসরি তার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এবং একাত্তর হলের হাসান সাঈদী ও এফ রহমান হলের তানভীর হাসান শান্তসহ কিছু নাম মামলার জন্য প্রস্তাব দিলে সাদিক সায় দেন—“তোমরা দাও”। তবে শেষ পর্যন্ত এই নামগুলো মামলার তালিকায় ওঠেনি।

কাদের আরও বলেন, “সাঈদী ছাত্রলীগের হয়ে বিভিন্ন অপকর্মে জড়িত ছিলেন, পরবর্তীতে অপহরণ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে আবার শিবিরে সক্রিয় হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে গিয়ে বহিরাগত হিসেবে ধরা পড়ার পরও সাদিক ফোন করে অনুরোধ করেন তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য।”

এছাড়াও কাদের অভিযোগ করেন, শিবিরপন্থী ছাত্ররা ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে গেস্টরুম, মিছিলসহ সব কর্মসূচিতে জোর করে অংশগ্রহণ করত, পদ পাওয়ার আশায় ছাত্রলীগের চরিত্র রপ্ত করে। অনলাইনে ব্যাচ প্রতিনিধি নির্বাচনেও তারা কারচুপি করে নিজেদের লোক বসিয়ে দিয়েছে, যারা মামলার সিদ্ধান্তেও প্রভাব বিস্তার করেছে বলে তার দাবি।

শিবির ও ছাত্রলীগ—’অদ্ভুত জোট’?

আব্দুল কাদের বলেন, “জুলাইয়ের হামলার পর আমরা দেখেছি, শিবির ও ছাত্রলীগ—দুই পক্ষই তাদের লোকদের বাঁচাতে তদবির চালিয়েছে। এটি একধরনের অব্যক্ত সমঝোতার ইঙ্গিত দেয়।”

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “শিবির বারবার দাবি করছে তাদের কেউ ছাত্রলীগে ছিল না। তাহলে তারা বিগত এক যুগের হল কমিটি, শাখা কমিটি বা সাম্প্রতিক কমিটিগুলো কেন প্রকাশ করছে না?”

এই বিতর্ক ঢাবি ছাত্ররাজনীতিতে অনুপ্রবেশ, ছদ্মবেশী রাজনীতি, ও দলীয় সহিংসতার গভীর সংকটকে সামনে নিয়ে এসেছে। স্ক্রিনশট যুদ্ধ এবং পাল্টা বক্তব্যে শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতিতে নতুন করে সন্দেহ, বিভাজন ও অনাস্থার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, যা শুধু রাজনৈতিক আদর্শ নয়—শিক্ষাগত পরিবেশ ও সাংগঠনিক নীতিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *