জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দলগুলোর দ্বন্দ্ব তীব্রতর, কমিশনের সংলাপ শিগগির

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভাজন দিন দিন গভীর হচ্ছে। সংসদ নির্বাচনের আগে না পরে—এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান স্পষ্টতই ভিন্ন। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) (National Citizen Party) এবং জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) দাবি করছে, নির্বাচনের আগেই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে কীভাবে সংসদ ছাড়া এমন আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে, সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা তারা দিতে পারছে না।

অন্যদিকে, বিএনপি (BNP) ও সমমনাদের অবস্থান একেবারেই বিপরীত। তারা মনে করে, সাংবিধানিক বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করার একমাত্র জায়গা হলো নির্বাচিত সংসদ। বিএনপির যুক্তি, জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল, কোনোভাবেই এটি সংবিধানের ঊর্ধ্বে যেতে পারে না।

ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সনদের চূড়ান্ত খসড়া নিয়ে ইতোমধ্যে ২৪টি রাজনৈতিক দল মতামত দিয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি দল নির্বাচনের আগেই সনদের আইনি ভিত্তি দাবি করেছে। আগামী সপ্তাহে কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তৃতীয় ধাপের সংলাপে বসতে চায়। রোববার কমিশন অভ্যন্তরীণ বৈঠকে দিন-তারিখ ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করবে।

কমিশনের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শনিবার বৈঠক হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। রবিবার বিকেলে বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সঙ্গে বৈঠক হবে এবং তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে সনদ বাস্তবায়নের পথরেখা তৈরি করা হবে।

সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে দ্বন্দ্ব শুধু সময়কাল নিয়েই নয়, বরং এর আইনি স্বীকৃতি নিয়েও। বিএনপি লিখিত মতামতে বলেছে, সংবিধানই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সমঝোতার দলিল সংবিধানের ওপর স্থান পেতে পারে না। তবে তারা আশা করছে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বৈধ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া খুঁজে বের করে সনদ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ গণমাধ্যমে বলেন, “জুলাই সনদ একটি রাজনৈতিক দলিল। এটিকে সংবিধানের ঊর্ধ্বে রাখা হলে তা হবে বিপজ্জনক নজির।” তিনি আরও বলেন, অধ্যাদেশের মাধ্যমে যা সম্ভব সরকার চাইলে করতে পারে, তবে সংবিধান সংশোধনের বিষয়টি নির্বাচিত সংসদের হাতে থাকতে হবে।

অন্যদিকে, জামায়াতের সর্বশেষ অবস্থান হলো—জুলাই সনদের সব বিধান ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তাদের মতে, সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সনদের বিধানই প্রাধান্য পাবে। তারা আরও বলেছে, চূড়ান্ত মীমাংসার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের হাতে থাকুক এবং আদালতে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলা না হোক।

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, “আমরা সনদের অঙ্গীকার অংশের সঙ্গে একমত। তবে বাস্তবায়নযোগ্য সংস্কারগুলো চিহ্নিত করে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করা জরুরি।” তিনি জানান, গণভোটের পথে তারা নেই, বরং অধ্যাদেশ জারি করে দ্রুত সংবিধান সংশোধনের পক্ষে জামায়াত।

এনসিপির দাবি আরও এগিয়ে—নির্বাচনের আগে কোনো কালক্ষেপণ ছাড়াই সনদের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন। দলটির প্রস্তাব, গণপরিষদ গঠন করে সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়া হোক। শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, “সনদের আইনি ভিত্তি না দিলে কিংবা গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না করলে এটি জনগণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবে না। ব্যর্থ কোনো সনদে এনসিপি স্বাক্ষর করবে না।”

এভাবে জুলাই সনদকে ঘিরে রাজনৈতিক মাঠে যে মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে, তা কেবল আইনি ও সাংবিধানিক বিতর্কই নয়, বরং আসন্ন নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *