বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকোমোটিভ সংকট দীর্ঘদিনের এক জটিল সমস্যা। প্রতিদিনই পুরনো ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রেন চলাচলে বাধা তৈরি করছে, আর এতে যাত্রীসেবায় দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এমন অবস্থায় চীন থেকে অনুদান হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে ২০টি নতুন মিটার গেজ লোকোমোটিভ, যা রেল খাতের জন্য একটি বড় সহায়তা হিসেবে দেখা হচ্ছে। হাসিনা সরকারের পতনের পর এটিকে বাংলাদেশের জন্য চীনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এর আগে ২০২৩ সালে ভারত বাংলাদেশকে ২০টি পুরনো লোকোমোটিভ দিয়েছিল। এবার চীন অনুদানে যে ২০টি আধুনিক লোকোমোটিভ আনছে, তা শুধু সংকট নিরসনই করবে না, বরং জ্বালানি সাশ্রয় ও নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করবে বলেও আশা করা হচ্ছে। এ উদ্দেশ্যে রেল মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) ‘প্রকিউরমেন্ট অব ২০ মিটার গেজ ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভস ফর বাংলাদেশ রেলওয়ে আন্ডার চায়না গ্রান্ট’ শীর্ষক প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
প্রকল্পের প্রাথমিক উন্নয়ন প্রস্তাব (পিডিপিপি) অনুযায়ী, মোট ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে চীন দেবে এক হাজার ৫৯১ কোটি টাকা অনুদান আকারে। বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে যোগ করবে মাত্র ৪৪ কোটি টাকা। ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই বছরে প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। এর আওতায় শুধু লোকোমোটিভ নয়, প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশ, আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং প্রকৌশলী ও মেকানিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। মোট লোকোমোটিভ আছে ৩০৬টি—এর মধ্যে ১৭৪টি মিটার গেজ ও ১৩২টি ব্রড গেজ। সরকারি নথি বলছে, ১২৪টি মিটার গেজ ইঞ্জিন, অর্থাৎ বহরের প্রায় ৭১ শতাংশই তাদের নকশাগত আয়ুষ্কাল পার করেছে। এর মধ্যে ৬৮টি চলছে টানা ৪০ বছর ধরে, আর ৮৪টি পার করেছে ৩০ বছর। এসব পুরনো ডিজাইনের ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশ এখন সহজলভ্য নয়, বিদেশ থেকে উচ্চমূল্যে আনতে হয়। তবুও অনেক সময় প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ মেলে না। ফলে ঘন ঘন বিকল হয়ে পড়ে ইঞ্জিন, বাড়ছে জ্বালানি খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়।
একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, “পুরনো ইঞ্জিনের আউটপুটের তুলনায় মেরামতের ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। এতে নির্ভরযোগ্যতা ভয়াবহভাবে কমে গেছে।” এ পরিস্থিতিতে নতুন লোকোমোটিভ না আসলে পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে ঢাকা–চট্টগ্রাম ও লালমনিরহাট অঞ্চলে ট্রেন বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
২০২০ সালে প্রকাশিত ‘ওয়ার্কিং টাইম টেবিল (ডব্লিউটিটি-৫২)’ অনুসারে, কেবল মিটার গেজ সেকশনের জন্যই দরকার ছিল ২০৩টি লোকোমোটিভ, যেখানে সংরক্ষণের জন্য অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ হিসাব করা হয়েছিল। অথচ সক্রিয় লোকোমোটিভ এখন মাত্র ১৮২টি—অন্তত ২১টি ঘাটতি রয়েছে। বাস্তবে চাহিদা আরও বেড়েছে, যাত্রী ও মাল পরিবহন গত পাঁচ বছরে অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফলে আন্তনগর যাত্রীসেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্থানীয় ও মালবাহী ট্রেনকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। লোকোমোটিভের অভাবে নিয়মিত ওভারহোলিং বা রক্ষণাবেক্ষণ কাজও পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে, এতে বিদ্যমান ইঞ্জিনগুলো আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যাত্রী পরিবহনে রেলের অংশ ১০ শতাংশ এবং মাল পরিবহনে ১৫ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য রয়েছে। এ জন্য নতুন লোকোমোটিভ অপরিহার্য।
রেলওয়ে মাস্টারপ্ল্যানের প্রথম ধাপে ৭৪টি পুরনো লোকোমোটিভ প্রতিস্থাপন ও ৩৭টি নতুন লোকোমোটিভ কেনার সুপারিশ করা হয়েছিল, কিন্তু এত দিনে কেনা গেছে মাত্র ৩০টি। এমনকি আর্থিক সংকটে ২০১১ সালে ৭০টি লোকোমোটিভ কেনার পরিকল্পনাও বাতিল হয়েছিল। ফলে পুরনো ইঞ্জিনের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে।
চীনের এই অনুদান তাই রেলওয়ের জন্য তাৎক্ষণিক স্বস্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, আধুনিক ডিজেল-ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ শুধু নতুন ট্রেন চালুর সুযোগ তৈরি করবে না, বরং জ্বালানি সাশ্রয়, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হ্রাস এবং আয় বৃদ্ধিতেও সহায়ক হবে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মাত্র ২০টি ইঞ্জিন দিয়ে পুরো চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। রেলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আরও বড় বিনিয়োগ দরকার।
ইআরডির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, চীনের অনুদানভিত্তিক এ প্রকল্প তাৎক্ষণিক সমাধান হলেও এতে ঝুঁকি রয়েছে। অতীতে চীন অর্থায়িত প্রকল্পগুলোতে বিলম্ব, ব্যয় বৃদ্ধি এবং স্বচ্ছতা ঘাটতির অভিজ্ঞতা ছিল। নতুন প্রকল্পেও টেন্ডার বিলম্ব, নির্দিষ্ট প্রযুক্তি চাপিয়ে দেওয়া এবং খুচরা যন্ত্রাংশ বা জনবল সংকটের ঝুঁকি থেকে যায়। তাই ফিজিবিলিটি স্টাডি, স্বচ্ছ ক্রয়প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ এবং পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ বাজেট নিশ্চিত করা জরুরি।
ইআরডির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, রেল খাতের লোকোমোটিভ সংকট নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সাম্প্রতিক চীন সফরে আলোচনা হয়েছিল। তার আলোকে রেলওয়ে একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে। পরিকল্পনা কমিশন অনুমোদন দিলে ইআরডি আনুষ্ঠানিকভাবে চীনের কাছে তা উপস্থাপন করবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলসচিব ফাহিমুল ইসলাম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।