বরাবরের মত ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ভুলের পথে জামায়াত, নতুন রাজনীতির হিসাবনিকাশে কোনঠাসা

সংসদ নির্বাচন ঘিরে ছোট দলগুলোকে নিজেদের পাশে টানতে সক্রিয় বড় রাজনৈতিক দলগুলো। এই প্রেক্ষাপটে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একাধিক জোট গঠনের তৎপরতা, যেখানে কেউ নির্বাচনী জোটে আগ্রহী, কেউ যুগপৎ আন্দোলনে নিবদ্ধ, আর কেউ চাইছে ভোট ভাগাভাগির মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার। তবে এসব হিসাব-নিকাশের মাঝেই আবারও রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে ভুল করছে জামায়াতে ইসলামী।

আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলনে এক সময় বিএনপির সঙ্গে থাকা অনেক দল এখন নানা পথে ছড়িয়ে পড়েছে। বিএনপি চেষ্টা করছে পুরনো সঙ্গী ছাড়াও নতুন ছোট দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে। অন্যদিকে জামায়াতের নেতৃত্বে ইসলামপন্থি দলগুলো ভোটের ‘এক বাক্সে’ যাওয়ার কৌশল নিচ্ছে। অন্তত সাতটি ধর্মভিত্তিক দল মাঠে অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয়। তবে তারা সরাসরি নির্বাচনী জোট গঠনের কথা বলছে না, বরং একক প্রার্থী দিয়ে ভোটে অংশগ্রহণের নির্বাচনী সমঝোতার পথে হাঁটছে।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার (Mia Golam Porwar) বলেন, “জোটের অগ্রগতি হলে আমরা সাংবাদিকদের জানাবো। ঐক্যের আগ্রহ অনেক দলের মধ্যে আছে, সময় হলে বলা যাবে।”

তবে এখানেই দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নতুন প্রশ্ন। কারণ, বিএনপি যখন হেফাজতে ইসলাম ও ইসলামপন্থি দলের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে, তখন জামায়াতের প্রস্তাবিত ‘এক বাক্সে’ ভোটের ধারণা তাৎপর্য হারাচ্ছে। ৬ এপ্রিল বিএনপি গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে হেফাজতের সঙ্গে বৈঠক করে, আবার ১ আগস্ট ফটিকছড়িতে হেফাজতের আমীর মাওলানা শাহ মুহিববুল্লাহ বাবুনগরী (Shah Muhibbullah Babunagari)-র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন (Khandaker Mosharraf Hossain) বলেন, “আমরা এখনো কারও সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপারে আলোচনা করি নাই। তবে ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা হতে পারে, এই বিষয়টি লক্ষ্য করছি।”

হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী (Azizul Haque Islamabadi) জানান, হেফাজতের সঙ্গে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিএনপির নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে। এমন ইঙ্গিত থেকে স্পষ্ট—বিএনপি জামায়াতকে না জানিয়েই আলাদা ইসলামপন্থি ঘরানায় ঘাঁটি গাঁড়ার চেষ্টা করছে।

অন্যদিকে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতৃত্বে থাকা ইসলামী দলগুলো এখনও আনুষ্ঠানিক জোট গঠনে অনিচ্ছুক। মাওলানা গাজী আতাউর রহমান (Gazi Ataur Rahman) বলেন, “আমরা বারবার বলেছি, আমরা জোট করবো না। তবে একক প্রার্থী দিয়ে একসঙ্গে নির্বাচন করার বিষয়ে সমঝোতা হতে পারে।”

এই জায়গাতেই বিশ্লেষকদের মতে, ২০২৪ সালের পর আওয়ামী লীগের পতনের প্রেক্ষাপটে জামায়াতের প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই জোরালো ছিল। কিন্তু নিম্ন কক্ষে পিআর দাবি, মধ্যপন্থা দলগুলোকে আস্থায় আনতে না পারা, এবং ভোটে ধর্মভিত্তিক ‘এক বাক্সে’ কৌশলের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা জামায়াতকে আবারও ঐতিহাসিক রাজনৈতিক ভুলের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

মাঝারি ঘরানার দলগুলো এখন তৃতীয় জোট গঠনে আগ্রহী। গণতন্ত্র মঞ্চ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizens’ Party) ও গণঅধিকার পরিষদ (Gono Odhikar Parishad) সহ ৯টি রাজনৈতিক দল সম্প্রতি রাজধানীর হাতিরপুলে এক বৈঠকে মিলিত হয়েছে। তিন ঘণ্টার দীর্ঘ আলোচনায় নতুন রাজনৈতিক মঞ্চ গড়ার প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। চূড়ান্ত ঐকমত্যে পৌঁছালে জোটের ঘোষণা আসতে পারে বলে জানা গেছে।

এই বৈঠকে অংশ নিয়েছে নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জেএসডি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, ভাসানী জনশক্তি পার্টি, এনসিপি, এবি পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ। বিশেষ করে এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদের একীভূত হওয়ার আলোচনাও চলছে। যদিও এখনো একীভূত হলে দলের নাম কী হবে, তা নির্ধারিত হয়নি।

এমন অবস্থায় জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থান আরও কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকেই। তাদের মতে, জামায়াত রাজনৈতিক বাস্তবতা ধরতে না পারার পুরনো অভ্যাসে এখনও চলতে থাকলে, ২৪ পরবর্তী বাংলাদেশে জামায়াতের প্রধান বিরোধী দল হওয়ার সম্ভাবনাও ম্লান হয়ে যেতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *