জাতীয় রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে বিস্তৃত বিশ্লেষণ করেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নুরুল কবির (Nurul Kabir)। তিনি বলেছেন, যখন মূলধারার বড় দলগুলো নিজেদের ভেতরের দুর্বলতা ও অসংহত অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই তুলনামূলকভাবে সংগঠিত জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) প্রশাসন ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দৃশ্যমান প্রভাব বিস্তার করছে। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর থেকে তাদের সাংগঠনিক শক্তি না বাড়লেও, নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে আধিপত্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশনের আলোচিত অনুষ্ঠান ‘তৃতীয় মাত্রায়’ অংশ নিয়ে তিনি এসব মন্তব্য করেন। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক জিল্লুর রহমান।
আশার পর হতাশা
নুরুল কবির বলেন, গত বছরের জুলাই-আগস্টে মানুষ আশাবাদী হয়েছিল যে দেশে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, ভোটাধিকার ও নিয়মভিত্তিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন অনুযায়ী সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে উঠবে। কিন্তু এক বছর পেরিয়ে এখন দৃশ্যপট ভিন্ন। সরকারের কর্মক্ষমতা, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, দুর্নীতির অভিযোগ এবং তরুণ নেতৃত্বের আচরণ নিয়ে জনগণের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়েছে।
তিনি মনে করেন, নতুন সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা জন্মেছিল বিশেষত তখনই যখন মন্ত্রীরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁদের সম্পদের হিসাব প্রকাশ করার। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং এক বছরের মাথায় অনেক মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনের ভেতরেও দুর্নীতির প্রসঙ্গ সংবাদমাধ্যমে এসেছে।
ভুয়া মামলা ও রাজনৈতিক চাপ
নুরুল কবির অভিযোগ করেন, আন্দোলনকারী শক্তির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিদের সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব নেওয়া হয়েছে। এমনকি ভুয়া মামলা ও মামলা-বাণিজ্যের সংস্কৃতি আবারও ফিরে এসেছে। এ অবস্থায় জনগণের হতাশা স্বাভাবিক।
তিনি আরও বলেন, তথ্যমন্ত্রী মাহফুজ আলম যিনি একসময় ছাত্রনেতা ছিলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়েছেন। আইনগতভাবে কেবল প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) তাঁর মন্ত্রিত্ব বাতিল করতে পারেন বা তিনি চাইলে নিজেই পদত্যাগ করতে পারেন। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হচ্ছে না, যা রাজনৈতিক চাপের উপস্থিতিই প্রমাণ করে।
এনসিপি ও জামায়াত সংযোগের ইঙ্গিত
তিনি উল্লেখ করেন, নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি এখনো ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেনি, তাই তাদের অবস্থান স্পষ্ট নয়। গণতান্ত্রিক মধ্যপন্থা নাকি জামায়াতপন্থী ধারা—তা বোঝা যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে এনসিপি নেতাদের সঙ্গে জামায়াত নেতাদের প্রকাশ্য ও গোপন বৈঠকের খবর এসেছে। এ প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী ফেসবুকে মন্তব্য করে বলেছেন, দেশে ইতোমধ্যেই চার-পাঁচটি মওদুদীপন্থী দল আছে, তাই নতুন করে আরেকটি দরকার নেই। এরপর থেকেই তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জামায়াত-শিবির ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর তীব্র সমালোচনা ও আক্রমণের মুখে পড়েছেন।
বড় দলের অদক্ষতা ও জামায়াতের উত্থান
নুরুল কবির বলেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে গেলেও বিএনপি নিজেদেরকে সুসংহত ও সুসমন্বিত শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। নেতাদের ভিন্নমুখী বক্তব্য ও সাংগঠনিক অস্থিরতার কারণে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ সুযোগে জামায়াতে ইসলামী প্রশাসনের ভেতরে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়েছে এবং বর্তমানে তারা অনেকটা মনোলিথিক দলের মতো সংগঠিত অবস্থানে রয়েছে।
তিনি দাবি করেন, কিছু মন্ত্রী ও প্রধান উপদেষ্টার স্টাফদের সঙ্গেও জামায়াতের যোগসূত্র রয়েছে। যেহেতু তথ্যমন্ত্রী মাহফুজ আলম জামায়াতের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়েছেন, তাই তাঁর ওপর রাজনৈতিক চাপও মূলত সেই দিক থেকেই আসছে বলে ধারণা করা যায়।
বিএনপির জন্য সতর্কবার্তা
নুরুল কবির সতর্ক করে বলেন, এখন বিএনপির জন্য সময় এসেছে নিজেদের জামায়াতের সঙ্গে জড়িত কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত করার। একই সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোরও ভাবা উচিত—যারা দেশে সমতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়—তাদের জন্য উদ্বেগজনক যে, ইউনূস সরকারের আমলেই জামায়াত এমন ক্ষমতা দেখাতে পারছে যে তারা চাইলে মন্ত্রী পরিবর্তন পর্যন্ত চাপিয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ, যাদেরকে ইউনূস একসময় নিয়োগকর্তা বলেছিলেন, তাদেরই সরিয়ে দেওয়ার মতো আধিপত্য জামায়াত প্রশাসনের ওপর প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এটি শুধু এক মন্ত্রীর জন্য নয় বরং তার সহকর্মী এবং সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্যও গুরুতর বিষয়, যা ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখার প্রয়োজন।