রাষ্ট্র সংস্কারের নতুন অধ্যায় রচনায় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (National Consensus Commission)। কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ-২০২৫’-এর খসড়া ইতোমধ্যেই প্রণয়নের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। নির্বাহী আদেশের আদলে তৈরি এই খসড়ায় সই করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস (Dr. Muhammad Yunus)। সরকারের কাছে খসড়াটি আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই জমা দেওয়া হবে বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এই আদেশ জারির মধ্য দিয়েই আপাতত জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি গড়ে উঠবে। এরপর গণভোট ও নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে সনদের পূর্ণাঙ্গ সাংবিধানিক বৈধতা সম্পন্ন হবে। কমিশনের পক্ষ থেকে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, সরকারের কাছে এই বাস্তবায়ন সুপারিশ জমা দেওয়ার পর জুলাই সনদে স্বাক্ষর করতে পারে জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizens Party – NCP)। ইতিমধ্যে দলটির নেতারা কমিশনের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
এনসিপি জানিয়েছে, তারা বাস্তবায়ন আদেশের খসড়া দেখে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। তবে কমিশনের উদ্যোগকে তারা ‘অগ্রগতি’ হিসেবে দেখছে। এনসিপির সঙ্গে বৈঠকের পর কমিশন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে, যেখানে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নের সুপারিশ চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
কমিশন সূত্র বলছে, আদেশ জারি হলে গণভোটের প্রক্রিয়াও এতে নির্ধারিত থাকবে। গণভোট হবে সনদের আইনি ভিত্তির অন্যতম প্রধান ধাপ।
এনসিপির অবস্থান ও শর্তাবলি
কমিশনের সঙ্গে আলোচনার পর এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, জুলাই সনদে স্বাক্ষর শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটিই মূল। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “যদি বাস্তবায়নের জায়গাটা নিশ্চিত হয়, তবে এনসিপি সনদে সই করতে আগ্রহী।”
তবে তিনি কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যেন বাস্তবায়ন আদেশকে কোনো দলীয় চাপে পড়ে “কাগুজে দলিল” বানানো না হয়। এনসিপি মনে করে, জুলাই ঘোষণাপত্রের মতো প্রতীকী ঘোষণার পরিবর্তে এই আদেশে সুনির্দিষ্ট আইনগত কার্যকারিতা থাকতে হবে।
দলের যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, গণভোটে কী প্রশ্ন থাকবে সে বিষয়ে তারা কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছেন, কিন্তু সুনির্দিষ্ট উত্তর পাননি। তিনি জানান, সরকার যখন আদেশ জারি করবে, তখন তারা সেটি দেখে সিদ্ধান্ত নেবেন।
বাস্তবায়ন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত
শনিবার জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিশন এবং বিশেষজ্ঞ প্যানেল সনদ বাস্তবায়নের আইনি রূপরেখা পর্যালোচনা করে। উপস্থিত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন, আইন বিশেষজ্ঞ ড. শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক, ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক।
কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানান, আদেশের কাঠামো প্রায় প্রস্তুত এবং অচিরেই তা চূড়ান্ত হবে। প্রস্তাবিত আদেশে বলা হচ্ছে, আগামী সংসদ দ্বৈত ভূমিকায় থাকবে—একদিকে আইন প্রণয়ন, অন্যদিকে সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে কাজ করবে। ৯ মাসের মধ্যে তারা জুলাই সনদের সংস্কার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে।
তবে বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক হবে নাকি নির্দেশনামূলক—এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকে মনে করেন, এটি বাধ্যতামূলক না করে নির্দেশনামূলক করা উচিত, যাতে রাজনৈতিক বাস্তবতা বজায় থাকে।
তিনটি বিকল্প প্রস্তাব
কমিশন ও বিশেষজ্ঞ প্যানেল তিনটি বিকল্প প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেছে:
প্রথমত, যদি ৯ মাসে সংস্কার সম্পন্ন না হয়, সংসদ ও পরিষদ বিলুপ্ত হবে—তবে এতে নতুন রাজনৈতিক সংকটের আশঙ্কা রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, ৯ মাস পর স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধান সংশোধন হবে—এ প্রস্তাবও বাতিল হয়েছে, কারণ এটি আইনগতভাবে টেকসই নয়।
তৃতীয়ত, প্রথমে পরিষদ গঠিত হয়ে সংস্কার করবে, পরে সংসদ গঠন হবে—কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এটিও গ্রহণযোগ্য নয়।
ফলে চূড়ান্তভাবে সম্ভবত নির্দেশনামূলক আদেশেই স্থির হতে পারে কমিশন।
নোট অব ডিসেন্ট ও দলীয় মতপার্থক্য
বিএনপি (BNP) জুলাই সনদের নয়টি মৌলিক সংস্কার বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়েছে। দলটি বলেছে, তারা ক্ষমতায় গেলে এসব বাস্তবায়ন করবে না। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami), এনসিপি ও ইসলামী আন্দোলন গণভোটের মাধ্যমে পুরো সনদ অনুমোদনের দাবি জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞ প্যানেল পরামর্শ দিয়েছে যে, গণভোটে ভিন্নমত অন্তর্ভুক্ত না করাই শ্রেয়; অন্যথায় সংস্কার কার্যত থেমে যাবে। তবে কমিশন এখনো এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
কমিশন আশাবাদী, সব দলের ঐকমত্যেই জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পথ তৈরি হবে। সরকার গণভোটের তারিখ ও আদেশ জারির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। এখন সবার দৃষ্টি সরকারের দিকে—কখন তারা এই সাংবিধানিক আদেশ জারি করে ‘জুলাই সনদ’-এর আইনি যাত্রা শুরু করবে।


