দেশের অন্যতম খ্যাতিমান সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক (Dr. Shahdeen Malik) বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গণভোট এখনো একটি অপরিচিত প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র ‘গণভোট চাই’ বা ‘গণভোট চাই না’ বললেই হবে না—এটি বাস্তবায়নের জন্য একটি সুস্পষ্ট আইনি কাঠামো, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি, এবং বিস্তারিত নিয়মাবলি থাকা আবশ্যক।
সম্প্রতি নয়া দিগন্তকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. মালিক বলেন, “গণভোটের প্রশ্ন কী হবে, তার ফলাফলের পরিণতি কী হবে—এসব বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। এভাবে শুধু দাবি তোলা অর্থহীন।”
তিনি জানান, গণভোট পরিচালনার জন্য আলাদা আইন থাকা জরুরি, যেখানে প্রক্রিয়া, পর্যবেক্ষণ, গ্রহণযোগ্যতা ও বাস্তবায়নের নিয়মাবলি নির্ধারিত থাকবে। কিন্তু এসবের কোনোটিই এখনো তৈরি হয়নি।
“গণভোটের জন্য যে ব্যবস্থাপনা দরকার—নির্বাচনী কাঠামো, প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, প্রচার কৌশল—এসব তো বাস্তবিক অর্থে একেবারেই অনুপস্থিত,” বলেন ড. মালিক। “এই বাস্তবতায় গণভোট আয়োজন এখন ‘অসম্ভবের পর্যায়ে’ পৌঁছে গেছে।”
তাজাখবরের পাঠকদের জন্য তার সেই সাক্ষাৎকার হুবুহু দেওয়া হলো :
প্রশ্ন : গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের পরিবর্তে পরিস্থিতি কি অনেকটা সাংঘর্ষিক হয়ে উঠছে?
ড. শাহদীন মালিক : দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইলে তো আমার আপনার করার কিছু নেই। যাদের হাতে শক্তি আছে রাজনৈতিক শক্তি হোক বা অন্য কোনো শক্তি হোক তারা যদি দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়, বদ্ধপরিকর হয়, তাহলে তো আমাদের মতো সাধারণ নাগরিকের কিছু করার নাই।
প্রশ্ন : তাহলে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়?
ড. শাহদীন মালিক : যাওয়াটা তো আর ঠিক না। এখন বাংলাদেশ থেকে বাইরে যেতে চাইলেও বাঙালিকে আর কোনো দেশ ভিসা দেয় না। ওই পথও বন্ধ হয়ে গেছে। না যারা এখন প্রধান শক্তি তারা যদি এই সিদ্ধান্ত নেয় মারামারি করবেই, তাহলে আমি আপনে তো আর ঠেকাতে পারব না এবং দেশটা অস্থিতিশীল হবে, অস্থিতিশীল হলে সবার জন্য আরো সঙ্গীন হবে।
প্রশ্ন : কারো জন্য এ পরিস্থিতি কাম্য না, এত দিন ধরে ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনা করল, এখন নির্বাচন চলে আসছে, এখন যদি এ রাজনৈতিক মতবিরোধ দূর না হয় তাহলে এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হতে পারে?
ড. শাহদীন মালিক : হ্যাঁ সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু কথা হলো এ সিদ্ধান্ত তো আর আমার আপনার ওপর নির্ভর করবে না, তাইতো। যারা সিদ্ধান্ত নেয় তারা যদি তাদের অবস্থায় অনঢ় থাকে, তাহলে আমাদের তো কিছু করার নাই।
প্রশ্ন : রাজনৈতিক দলগুলো তো বলছে গণতন্ত্রে আলোচনা ও রাজপথে ভয়েস রেইজ করার মতো দুটো ব্যাপারই রয়েছে, দুটোই চলে, এরকমও বলা হচ্ছে…
ড. শাহদীন মালিক : না ধরেন সংসদ নির্বাচন আমরা সবাই বলছি। এই তো। ভালো হোক খারাপ হোক অনেকগুলো এক ডজনবার নির্বাচন হয়েছে, খারাপই যদি বেশি, জনগণের সাথে পরিচিত এসব নির্বাচন কিন্তু গণভোটের সাথে জনগণ তো পরিচিত না। এখন কোন প্রশ্নে গণভোট হবে, গণভোটের ফলাফলের পরিণতি কী হবে, এগুলো নিয়ে তো কোনো আলাপ আলোচনাই হয় নাই। খালি গণভোট চাই আর গণভোট চাই না, গণভোট করতে হলে যে আইন তৈরি করতে হবে, আইনে এগুলো বলে রাখতে হবে, গণভোটের জন্য যে ব্যবস্থা করা, নির্বাচনী ব্যবস্থা এগুলো তো বাস্তবিক অর্থে যেটা কাম্য, অকাম্য সেটা পরের কথা কিন্তু বাস্তবিকভাবে এটার বাস্তবায়নটা তো এখন অসম্ভবের পর্যায়ের দিকে চলে গেছে, গণভোট করতে দুনিয়ায় যেটা হয়, আগে গণভোটের একটা প্রস্তাব নির্বাচিত সংসদ পাস করল। যেমন বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থায় পরিবর্তন করব, আগে এটা সংসদে পাস করতে হয়, তার পর দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে তখন জনগণের কাছে যাওয়া হয়, অতিগুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় ধাপ হিসেবে গণভোটে দিতে হয়। আমরা তো বলছি উল্টা কথা। দুনিয়াতে যেটা কেউ করে নাই, হ্যাঁ তার পরে যে আমরা সেটা করতে পারব না সেটা না, তবে দুনিয়াতে সব সময় হয় আগে প্রতিনিধিত্বমূলক মানে সংসদই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটা প্রস্তাব পাস করে, তার পর এটা গণভোটে দেয়। কিন্তু এসব টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে কেউ কোনো আলোচনাই করছে না। আর ৮৪টি প্রস্তাবের পক্ষে কে গণভোট দেবে, এই ৮৪টি প্রস্তাব ২৫ পৃষ্ঠার দলিল পড়ে বুঝে ওটার পক্ষে হ্যাঁ কিংবা না ভোট দেয়ার মতো লোক, বিষয়টা খুব কঠিন।
প্রশ্ন : তাহলে গণভোট কি অসম্ভব?
ড. শাহদীন মালিক : গণভোট জিনিসটা ভালো কিন্তু সব জিনিসের তো একটা নিয়ম আছে। আমি তো বলেছিলাম যেটা খুব চাউর হয়েছে যে ঐকমত্য কমিশনে আলোচনার। যে মই বেয়ে চাঁদে কেউ যায় নাই কিন্তু মই বেয়ে চাঁদে যাওয়ার আলোচনা আমরা ৬ মাস কেনো ৬ বছরও করতে পারি। কিন্তু সম্ভাব্য ফলাফল মই বেয়ে তো চাঁদে যাওয়া যাবে না। তো এখন মই বেয়ে চাঁদে যাওয়ার আলোচনায় সবাই ব্যস্ত কিছু করার নাই তো।
প্রশ্ন : তাহলে সরকার, রাজনৈতিক দল, সাধারণ মানুষ সবাই পক্ষ-বিপক্ষে রূপ নিচ্ছে? একাট্টা হয়ে একটা গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না?
ড. শাহদীন মালিক : না যদি সব বিষয়ে সব রাজনৈতিক দল একমত হতো, তাহলে আর ভিন্ন রাজনৈতিক দল থাকত কেনো? এখন যদি ইসলামী দলের সাথে বামপন্থী দলগুলো একমত হয়ে গেল, বামপন্থী দলগুলো জঙ্গি দলগুলো এক হয়ে গেল তাহলে এত রাজনৈতিক দলের দরকার কি? পঁচাত্তরের একদলীয় শাসনব্যবস্থায় তাহলে ফিরে যেতে চাচ্ছি। পুরো জিনিস বা আলাপ-আলোচনাটাই হচ্ছে অবাস্তব। আর এখানে সংবাদপত্রের ভূমিকা আমার কাছে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক লাগে। সংবাদপত্রগুলো এই আটটা মাসে খালি এগুলো নিয়ে আলোচনা করছে। দেশে আর কোনো সমস্যা নাই মানে বেকার সমস্যা নাই, দারিদ্র সমস্যা নাই, চিকিৎসার সমস্যা নাই, শিক্ষার সমস্যা নাই, কোনো কিছু নাই, সবাই প্রত্যেক দিন সকাল বিকাল সব মাধ্যম ছোট হোক বড় হোক মেইন স্ট্রিম মিডিয়া হোক খালি সবাই ঐকমত্য কমিশন, ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্যের অচলাবস্থার জন্য মিডিয়াগুলো বহুলাংশে দায়ী।
প্রশ্ন : তাহলে আমাদের ওয়ে আউটটা কি?
ড. শাহদীন মালিক : না না, অনেক সমস্যার ওয়ে আউট থাকে না। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ হচ্ছে সাড়ে তিন বছর ধরে, সারা দুনিয়া তো ওয়ে আউটের চিন্তা করছে কিন্তু হচ্ছে না। সুদানে দুই বছরে বোধ হয় দুই লাখ মানুষ মারা গেছে, আফগানিস্তান তো চল্লিশ বছর ধরে মারামারি করেছে, যখন অনেকগুলো জাতি অনেক অবস্থায় চলে যায় সেটা এক কথায় এক দিনে ওয়ে আউট হয় না। এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য আর আমরা যারা জাতির বিলং করি আমাদের সবারই অবস্থা আরো সঙ্গীন হবে। দুনিয়ায় ৮০০ কোটি মানুষের মধ্যে ২০০ কোটি মানুষ মারামারিতে আক্রান্ত। বৈদেশিক হোক অভ্যন্তরীণ হোক সংঘর্ষ চলছে এসব দেশে। আমরা না হয় এসব জায়গায় আরো ১০ কোটি যোগ হবো আর কি। তার পর ৬ মাস পর ২১০ কোটির হিসাব হবে।
প্রশ্ন : আপনার আশঙ্কা সত্যি না হোক, কিন্তু বড় একটি রাজনৈতিক দল বলে দিয়েছে গণভোট নিয়ে আলোচনায় বসবে না, তাহলে আমরা কি পয়েন্ট অব নো রিটার্নের দিকে যাচ্ছি?
ড. শাহদীন মালিক : হ্যাঁ সব দেশে রাজনৈতিক শক্তিগুলো পয়েন্ট অব নো রিটার্নে চলে যায় ভিন্নমুখী অবস্থানে গেলেই তো। সমঝোতা বা ছাড় দেয়ার মানসিকতা থাকে না আর ছাড় দেবে কেনো যখন উভয় পক্ষ ভাবছে যে আমি জিতব। যে খেলায় আমি জিতব সে খেলায় আমি হার মেনে নেবো কেনো? আসলে এসব সমস্যার কোনো সমাধান আমার কাছে নেই।


