‘ঘনিষ্ঠ মিত্র’ তাই শেখ হাসিনাকে ফেরত দেবে না ভারত

বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে নোট ভারবাল (আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক বার্তা) পাঠিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) গত ১৭ নভেম্বর শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পাঁচ দিন পর এ অনুরোধ পাঠানো হয়। অভিযোগ ছিল, গত বছরের জুলাই-আগস্টের শিক্ষার্থী আন্দোলন দমনে নির্দেশনা দিয়ে তারা প্রায় ১,৪০০ মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

ঢাকার এই আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপটি আগে থেকেই প্রত্যাশিত ছিল। রায় ঘোষণার পরই অন্তর্বর্তী সরকার কড়া ভাষায় দিল্লির কাছে দুইজনকে দ্রুত বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর আহ্বান জানায়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী এটি (প্রত্যর্পণ) ভারতের ‘বাধ্যতামূলক দায়িত্ব’। তারা আরও সতর্ক করে দেয়, মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়া হলে তা হবে ‘অমিত্রসুলভ আচরণ’ ও ন্যায়বিচারের প্রতি আঘাত।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন এবং তারপর থেকে সেখান থেকেই বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার দিয়ে যাচ্ছেন।

গত এক বছর ধরে তার প্রত্যর্পণের দাবি তুললেও ভারত আগের অনুরোধগুলোর জবাব দেয়নি। গত বছরের ডিসেম্বরে পাঠানো প্রথম নোট ভারবালে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু গ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করেছিল। দ্বিতীয় অনুরোধেরও এখনো কোনো প্রত্যক্ষ সাড়া দেয়নি দিল্লি।
আইসিটির রায়ের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুধু জানিয়েছিল, তারা ‘রায়টি লক্ষ্য করেছে’ এবং বাংলাদেশের শান্তি, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতার পক্ষে থাকবে—কিন্তু প্রত্যর্পণ প্রসঙ্গ একেবারেই এড়িয়ে গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, দিল্লি এই মুহূর্তে কোনো বড় পদক্ষেপ নেবে না। ভারতের গবেষক স্মৃতি এস. পট্টনায়ক বলেন, বাংলাদেশে বর্তমান সরকার ‘অস্থায়ী ও সীমিত ম্যান্ডেট’ নিয়ে চলছে। তাই একটি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরই দিল্লি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে সিদ্ধান্ত নেবে।

ভারতে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণের বিরোধিতা যথেষ্ট প্রবল, যা রায় ঘোষণার পরে আরও শক্ত হয়েছে। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্কের বিষয়টি গুরুত্ব দেয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সহযোগিতা, ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের পর শেখ হাসিনা ও তার বোনকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া, এবং পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলে ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থে তার সহযোগিতা—এসব কারণেই দিল্লির কাছে তাকে ‘ঘনিষ্ঠ মিত্র’ হিসেবে দেখা হয়। তাই একজন ‘বন্ধু’কে মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি পাঠানো ভারতের জন্য রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর।

২০১৩ সালের প্রত্যর্পণ চুক্তি থাকলেও ভারত চাইলে ‘রাজনৈতিক চরিত্রের অপরাধ’ ধারা ব্যবহার করে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে। যদিও খুন বা হত্যার মতো অপরাধ এই ধারার আওতায় পড়ে না, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগের সরাসরি সম্পৃক্ততা প্রমাণ কঠিন হবে। ভারত আরও প্রশ্ন তুলতে পারে যে বিচার প্রক্রিয়াটি ন্যায্য হয়নি বা ট্রাইব্যুনালের বৈধতা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এমনকি যদি দিল্লি ইতিবাচক সাড়া দেয়ও, তবু ভারতের আদালতে পূর্ণাঙ্গ প্রত্যর্পণ শুনানি হবে—যেখানে শেখ হাসিনা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন।

বাংলাদেশে ভারতের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক স্বার্থ অনেক বড়। তাই ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে দিল্লি সতর্ক অবস্থান ধরে রাখবে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। অনেকেই মনে করেন, ভারতকে এখন ‘ধীরে, নীরবে’ এবং সব পক্ষকে নিয়ে সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে। তবে সামনে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হলে ভারতবিরোধী বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারে, যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও চাপের মুখে ফেলতে পারে।

লেখক: দ্য ডিপ্লোম্যাটের দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *