হাসিনার মদদে ‘নগদ’-এর অভিনব জালিয়াতি – রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ছাপিয়েছে টাকা

বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান নগদ ( Nagad ) ভয়াবহ আর্থিক জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ই-মানি তৈরি করে নগদ টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এছাড়া, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে আরও ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে।

হাসিনার প্রত্যক্ষ মদদ

এই কেলেঙ্কারিতে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করেছেন ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ( Sheikh Hasina )। তার পুত্র ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ( Sajeeb Wazed Joy ) সরাসরি এর সুবিধাভোগী ছিলেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফজলে কবির ( Fazle Kabir ) এবং তার উত্তরসূরি আব্দুর রউফ তালুকদার ( Abdur Rouf Talukder ) এ অনিয়মের বিষয়ে অবগত থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেননি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য

বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ( Bangladesh Bank ) নগদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে একাধিক প্রতিবেদনে গুরুতর জালিয়াতির তথ্য প্রকাশ করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, বাংলাদেশে এটাই প্রথমবার কোনো প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল মাধ্যমে মানি ক্রিয়েশন বা ই-মানি তৈরি করে অবৈধভাবে অর্থ বাজারে প্রবাহিত করেছে। বিষয়টি কার্যত নতুন টাকা ছাপানোর সমতুল্য, যা আইনত কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ারভুক্ত।

এই অপরাধের দায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নগদের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মামলা দায়ের করেছে। এটি অবৈধভাবে টাকা ছাপানোর ঘটনায় দেশের ইতিহাসে প্রথম মামলা। পাশাপাশি, দুর্নীতি দমন কমিশন ( Anti-Corruption Commission ) নগদের বিরুদ্ধে ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলা করেছে।

নগদের জালিয়াতির ধরন

সূত্র মতে, ডাক অধিদপ্তর ও নগদের পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান থার্ড ওয়েভ টেকনোলজি ( Third Wave Technology )-এর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, নগদের ব্যাংক হিসাবে যত টাকা থাকবে, ঠিক সমপরিমাণ ই-মানি ইস্যু করা যাবে। কিন্তু নগদ এর চেয়ে ৬৪৫ কোটি টাকা বেশি ই-মানি তৈরি করেছে

এছাড়া, অনুমোদন ছাড়াই ৪১টি পরিবেশকের হিসাব খুলে ১ হাজার ৭১১ কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়, যা মূলত সরকারি ভাতা বিতরণের জন্য নির্ধারিত ছিল। তবে, সংশ্লিষ্ট পরিবেশকরা ভাতা বিতরণ না করে বরং অর্থ আত্মসাৎ করেছে। বিশেষ করে, যারা ভাতা পাওয়ার পর ৩ দিনের মধ্যে টাকা উত্তোলন করেননি, তাদের অর্থ নগদ নিজেই তুলে নিয়েছে

নগদের লাইসেন্স পেতে রাজনৈতিক প্রভাব

নগদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনার লাইসেন্স পেতে ব্যর্থ হয়। পরে, ডাক বিভাগের আইন সংশোধন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়াই মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু করে। ২০২০ সালে নগদ সাময়িক লাইসেন্স পেলেও স্থায়ী লাইসেন্স পায়নি

প্রতিটি ক্ষেত্রে নগদ যোগ্যতার শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হলেও, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে নগদ বিশেষ সুবিধা পেয়ে আসছে।

নগদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা

২০১০ সালে বাংলাদেশ ডাকঘর নগদ নামে পোস্টাল ক্যাশ সেবা চালু করে। পরে, ২০১৭ সালে থার্ড ওয়েভ টেকনোলজির সঙ্গে চুক্তি হয়, যা ২০২০ সালে নগদ লিমিটেড নামে পরিবর্তিত হয়।

নগদের মালিকানায় আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা জড়িত ছিলেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় ছিলেন এই প্রকল্পের অন্যতম নেপথ্য নায়ক। এছাড়া, নগদের কার্যক্রম শুরুতে আওয়ামী লীগের সাবেক দুই সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও রাজী মোহাম্মদ ফখরুল শেয়ারহোল্ডার ছিলেন।

এছাড়া, নগদের শেয়ারহোল্ডার নিয়াজ মোর্শেদ যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ফলে, নগদের পরিচালনায় সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান ছিল।

নগদ কেলেঙ্কারিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীরবতা

২০১৮ সালের ৮ আগস্ট সাবেক গভর্নর ফজলে কবির-এর সময়ে ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে নগদের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালুর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করা হয়। তবে, শর্ত পূরণ না করায় তা অনুমোদিত হয়নি।

পরে, ২৬ মার্চ ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা নগদের উদ্বোধন করেন এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম শুরু করে। এরপর থেকেই নগদ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের মুখে পড়ে।

সরকারি ভাতা নগদের মাধ্যমে বিতরণের অনুমতি দেওয়ার পর, সজীব ওয়াজেদ জয় ব্যক্তিগতভাবে তৎকালীন গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে কথা বলে নগদকে বিশেষ ছাড় পাইয়ে দেন

নগদে প্রশাসক নিয়োগ ও দুর্নীতির উন্মোচন

২০২৩ সালের ২১ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক নগদে প্রশাসক নিয়োগ দেয়। দায়িত্ব গ্রহণের পর সংশ্লিষ্ট দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হয় এবং তদন্তে নগদের বিপুল অর্থ জালিয়াতির তথ্য প্রকাশ পায়।

এত বড় অনিয়মের পরেও কেন এতদিন ধরে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নগদকে রক্ষা করা হয়েছে, তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠছে।


Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *