বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে বেনামি ঋণের ভয়াবহ চিত্র দিন দিন স্পষ্ট হচ্ছে। সাতটি বড় শিল্পগ্রুপ ভুয়া কোম্পানি, জাল কাগজপত্র ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ নিয়েছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। এসব বেনামি ঋণের সবচেয়ে বড় অংশীদার এস আলম গ্রুপ (S. Alam Group)। তদন্তে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, শুধু এই গ্রুপই বেনামে ঋণ নিয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা।
এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল ইসলাম মাসুদ সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তদন্তে দেখা যায়, গ্রুপটি মোট ২ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। এর মধ্যে বেনামে ৫৯.৪৬ শতাংশ, অর্থাৎ ১ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা। এসব ঋণের বড় অংশই এসেছে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে, যার মধ্যে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার অর্থ পাচারের প্রমাণ মিলেছে। জাল প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা অ্যাকাউন্টে টাকা ছাড় করে পরে কাগজপত্র সরবরাহের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
তদন্তে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ (Beximco Group)। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন এই গ্রুপ বেনামে ঋণ নিয়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। তবে মোট ঋণ আরও বেশি—৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি বলে জানা গেছে। বেক্সিমকো ১৮৮টি কোম্পানির মাধ্যমে ঋণ নিয়েছে, যার মধ্যে ৭৮টি কোম্পানি সরাসরি ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি ঋণের টাকা তুলেই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। এসব জালিয়াতির কিছু দায় গ্রুপটি স্বীকারও করেছে।
তালিকায় আরও আছে নাবিল গ্রুপ (Nabil Group)। মোট ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৯৫০০ কোটি টাকাই বেনামে নেওয়া হয়েছে, যা মোট ঋণের ৭০ শতাংশের বেশি। এই গ্রুপ মূলত এস আলম গ্রুপের প্রভাবাধীন ব্যাংক থেকেই অর্থ তুলেছে।
নাসা গ্রুপ (Nasa Group)-এর নামেও রয়েছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেনামি ঋণ। ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে নেওয়া এসব ঋণের মূল সুবিধাভোগী হিসেবে কাজ করেছে নাসা গ্রুপ। গ্রুপটির মালিক নজরুল ইসলাম মজুমদার বর্তমান সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
আরামিট গ্রুপ (Aramit Group)-এর বেনামি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (UCB) থেকে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছে। গ্রাহকেরা মূল সুবিধা না পেলেও সাইফুজ্জামান চৌধুরী এ ঋণের আসল সুবিধাভোগী বলে মনে করছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
সিকদার গ্রুপ (Sikder Group)-এর বেনামি ঋণ ২২০০ কোটি টাকার বেশি। এর বড় অংশই এসেছে তাদের মালিকানাধীন ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে। এই ঋণের একটি বড় অংশ মাইশা গ্রুপের নামে নেওয়া হলেও সুবিধা নিয়েছে সিকদার গ্রুপ।
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU) এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের চলমান যৌথ তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তারা ব্যাংক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ, নথিপত্র যাচাই এবং লেনদেন বিশ্লেষণের মাধ্যমে মূল সুবিধাভোগীদের শনাক্ত করছে। নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ভবিষ্যতে যেন এসব বেনামি ঋণ সংশ্লিষ্টদের আসল নামে দেখানো হয়।
২০০২ সাল থেকেই দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন বলবৎ রয়েছে। এই আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, কোনো ব্যাংক হিসাব খুলতে হলে গ্রাহকের পরিচয় যাচাই করতেই হবে। তারপরও ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা এসব আইনের তোয়াক্কা না করে ভুয়া হিসাব খুলে বিশাল অঙ্কের ঋণ ছাড় করেছেন।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর কিছু ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও এসেছে পরিবর্তন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইউসিবি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ নতুন করে গঠন করা হয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু পর্ষদ বদল যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন বিচার ও জবাবদিহিতার।