অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠন নিয়ে যা বলছেন বিশেষজ্ঞরা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস (Muhammad Yunus) যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে দেশের রাজনীতি ও সংবিধান কোন মোড়ে যাবে—এই প্রশ্ন ঘিরে জোর আলোচনা চলছে। আইনবিদদের বিশ্লেষণ, বিচারিক রায়, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং জাতীয় নিরাপত্তা—সবই এসে মিলেছে একটি স্পর্শকাতর ক্রসরোডে।

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আংশিকভাবে হাইকোর্টের মাধ্যমে ফিরে আসার সুযোগ পায়। এই পরিবর্তনের পটভূমিতে ৮ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চাপে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন অধ্যাপক ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে।

কিন্তু এখন অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগের সম্ভাবনা ঘিরে এক নতুন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

সংবিধান বনাম বাস্তবতা

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক (Shahdeen Malik) মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সংবিধান কার্যত অচল। তিনি বলেন, “আইন অনুযায়ী কিছুই হচ্ছে না। এখন সবই চলছে রাজনৈতিক বাস্তবতায়। সংবিধান আর এখানে প্রাসঙ্গিক নয়।” তাঁর ভাষায়, এখন ‘জোড়াতালির’ উপর ভর করেই রাষ্ট্র চলছে।

এই অবস্থায় যদি ইউনূস পদত্যাগ করেন, তাহলে নতুন সরকার গঠনের প্রশ্ন উঠবে, যা আবারও সংবিধানের বাইরের একটি পথ হতে পারে বলে তিনি ইঙ্গিত দেন।

রাজনৈতিক বাস্তবতা ও আইনগত ব্যাখ্যা

অপরদিকে, আরেক বিশিষ্ট আইনজীবী মনজিল মোরসেদ (Manzill Murshid) বলেন, গণঅভ্যুত্থানের মুখে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তখন প্রয়োজনের তাগিদেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। তবে এখন আর সেই প্রয়োজন নেই, এখন দরকার নির্বাচন। তাঁর মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করলেই চলবে, নতুন করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দরকার নেই।

তিনি আরো বলেন, “নির্বাচন দিতে গেলে এই সরকারের আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকার সুযোগ নাই। আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনার সুযোগ রাখা হয়েছে।”

উপদেষ্টা পরিষদের ভবিষ্যৎ কী?

যদি অধ্যাপক ইউনূস পদত্যাগ করেন, তাহলে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা কি দায়িত্বে থাকবেন? এ প্রশ্নে মনজিল মোরসেদ বলেন, প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের মনোনীত করেছেন বলে তিনিই তাঁদের অবস্থান নির্ধারণ করবেন। তিনি না থাকলে তাঁর মনোনীত উপদেষ্টাদের অবস্থানও বাতিল হবে।

অন্যদিকে শাহদীন মালিক বলেন, সবকিছু এখন “ইচ্ছামতো চলছে”, আর এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হলে রাজনৈতিক ঐকমত্য জরুরি।

ইউনূসের পদত্যাগের কারণ

সরকার এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি, তবে নাহিদ ইসলাম (Nahid Islam) এর মাধ্যমে মুহাম্মদ ইউনূসের মনোভাব সামনে এসেছে। তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমি তো এভাবে কাজ করতে পারবো না। রাজনৈতিক দলগুলো একটা জায়গায় এক হতে পারছে না।”

এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, অধ্যাপক ইউনূস রাজনীতিক দলগুলোর অনৈক্যের মধ্যে কাজ করতে পারছেন না বলেই পদত্যাগের কথা ভাবছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের শঙ্কা

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ বলেন, এখন পদত্যাগ করলে তা দেশের জন্য ভয়ংকর সংকট তৈরি করবে, এবং এই অবস্থায় দেশকে বের করে আনার সক্ষমতা কারো নেই।

তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের দিকেও ইঙ্গিত করেন, যা বাংলাদেশের ভেতরে অনৈক্যের মাধ্যমে নতুন ফ্যাসিবাদ ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে।

একইসঙ্গে সুজন (Sushashoner Jonno Nagorik) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইউনূস পদত্যাগ করলে দেশের ভবিষ্যৎ চরমভাবে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। “দেশ অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং এর মাশুল দিতে হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।”

তিনি জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে যুক্ত সব শক্তির ঐক্যের আহ্বান জানান।

রাজনৈতিক দলের আস্থা সংকট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যথেষ্ট কথা বলছে না। অনেক উপদেষ্টার মনোভাব এমন যেন এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সরকার। তিনি বলেন, “সংস্কার, বিচার ও নির্বাচনের যে লক্ষ্য ছিল, তা স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু এমন অনেক ‘নিরপেক্ষ’ উপদেষ্টা রাখা হয়েছে, যারা অতীতে ফ্যাসিবাদের সময় চুপ ছিলেন।”

এই পরিস্থিতিতে তিনি সরকারের কাঠামোতে পরিবর্তন এনে, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন।

সামনে কী?

আইন অনুযায়ী নির্বাচনের অন্তত ৯০ দিন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। তবে এখন এই গঠনের রেফারেন্স সুপ্রিম কোর্ট থেকে আনতে হবে কি না, তা নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, পেছনে ফিরে তাকানোর সময় এখন নেই, বরং সামনে কীভাবে রাজনৈতিক ঐক্য ও আইনগত কাঠামোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে অচলাবস্থার অবসান ঘটানো যায়, সেদিকেই নজর দিতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *