দেশ যখন একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের অপেক্ষায়, ঠিক সেই সময়েই রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনী ব্যবস্থা, বা পি.আর. (Proportional Representation) পদ্ধতি। ২৮ জুন রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন (Islami Andolon Bangladesh) আয়োজিত এক মহাসমাবেশে উঠে আসে এ দাবির মূল সুর।
যদিও আয়োজক হিসেবে সামনে ছিল ই.শা.আ. বা ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, বিশ্লেষকরা বলছেন, বাস্তবিক অর্থে এটি ছিল জামায়াতে ইসলামীর (Jamaat-e-Islami) শোডাউন। মঞ্চে ওঠেন ‘ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি)’, ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)’, ‘নেজামে ইসলাম পার্টি’, ‘হিন্দু মহাজোট’, ‘হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ’, ‘গণঅধিকার পরিষদ’, ‘বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ’, ও ‘খেলাফত আন্দোলন’-এর নেতারা। কিন্তু বড় রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি (BNP) ও তাদের মিত্রদের কাউকে দেখা যায়নি।
বিশ্লেষকদের প্রশ্ন—হঠাৎ এই পি.আর. পদ্ধতির উত্থান কি রাজনৈতিক সংস্কারের ইঙ্গিত, নাকি এটি পুরনো রাজনৈতিক কাঠামো ভাঙার নামে একনায়কতন্ত্র কিংবা আঞ্চলিক মাফিয়াতন্ত্রের প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র?
পি.আর. পদ্ধতির বাস্তবতা ও সাংবিধানিক প্রশ্ন
মনজিল মোরসেদ (Monjil Morshed), সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, এই আলোচনাকে ‘অর্থহীন’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “এখন নির্বাচন নয়, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। সংবিধান ও নির্বাচন আইন অনুযায়ী যা আছে, তা পরিবর্তন করতে হলে ক্ষমতায় যেতে হবে। এ দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের নয়।”
তাঁর মতে, এটি মূলত একটি বিভ্রান্তিমূলক রাজনৈতিক চাল—যার উদ্দেশ্য নির্বাচন পেছানো এবং ক্ষমতা ধরে রাখা। তরুণ প্রজন্ম প্রস্তুত থাকলেও, বাস্তব পরিবর্তন আনতে হলে সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতায় গিয়েই তা করতে হবে।
অন্যদিকে, সিনিয়র অ্যাডভোকেট দেলোয়ার হোসেন চৌধুরী (Delwar Hossain Chowdhury) বলছেন, “এই পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। সবাই চাইলেও যদি বিএনপি না চায়, তাহলে বাস্তবায়ন হবে না।” তিনি প্রস্তাব করেন, ঐকমত্য না হলে গণভোটের আয়োজন করা যেতে পারে ফেব্রুয়ারির আগেই। নয়তো একটি জাতীয় সরকার গঠন করা উচিত। তিনি সংবিধান স্থগিত হওয়ার আশঙ্কাও ব্যক্ত করেন।
জামায়াতের পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য
পি.আর. পদ্ধতির প্রধান দাবিদার জামায়াত। সংখ্যানুপাতিক ভিত্তিতে আসন বণ্টনের দাবির পেছনে তাদের যুক্তি হলো—’টাকার খেলা’ বন্ধ করা।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের একটি উদাহরণে বলা হচ্ছে, একটি আসনে বিএনপি যদি ৫ লাখ, জামায়াত ৩ লাখ এবং আওয়ামী লীগ ১ ভোট পায়—তবে বিজয়ী বিএনপি হলেও, পি.আর. পদ্ধতিতে জামায়াতও তার ভোটের অনুপাতে সংসদে সিট পাবে। এর ফলে ছোট দলগুলো আলাদা করে কোনো আসনে জিততে না পারলেও, সম্মিলিত ভোটে প্রতিনিধিত্ব পাবে।
এই পদ্ধতিতে ১ শতাংশ ভোট পেলেই দলটি ৩টি সিট পাবে। ফলে ছোট দলগুলোও সংসদে অবস্থান নিতে পারবে—এটি তাদের জন্য সুবিধাজনক।
তবে প্রশ্ন রয়ে যায়—জামায়াত কি চিরদিন ছোট দল থাকবে? বিএনপি কি জামায়াতের ‘কল্পনার বাংলাদেশ’-এর অংশ হবে? রাজনৈতিক বাস্তবতায়, ক্ষমতার প্রশ্ন অস্বীকার করে কোনো দল রাষ্ট্র পরিচালনায় অগ্রসর হতে পারে না।
তবে তাদের এই ব্যাখ্যাতেও রয়েছে গলদ। পি.আর. পদ্ধতির নির্বাচনে সাধারণত একটি ন্যূনতম ভোটের সীমাবদ্ধতা থাকে। অর্থাৎ, কোনো দলকে সংসদে অংশগ্রহণ করতে হলে কমপক্ষে ৫% ভোট পেতে হয়। শুধুমাত্র সেই শর্ত পূরণ করলেই তারা সংসদে আসন পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কয়টি দলের সেই সক্ষমতা রয়েছে, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন থেকে যায়। সেক্ষেত্রে, কিছু ছোট দল কেন এবং কী বিবেচনায় পি.আর. পদ্ধতির পক্ষে জামায়াতের অবস্থানের সঙ্গে সাযুজ্য করছে, তা সত্যিই বোধগম্য নয়।
ভারতীয় এজেন্ডা ও রাজনৈতিক ফ্যাসিবাদ?
ডা. পিনাকী ভট্টাচার্য (Dr. Pinaki Bhattacharya), একজন জনপ্রিয় অ্যাক্টিভিস্ট ও বিশ্লেষক, এই পি.আর. আন্দোলনের পেছনে ভারতীয় পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তাঁর মতে, এটি ফ্যাসিবাদের নতুন মুখোশ, যেখানে ভোট অনুপাতে আসন ভাগাভাগির আড়ালে দেশকে এক ‘মাফিয়াতন্ত্রে’ ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি প্রশ্ন তোলেন—ইউরোপে এই পদ্ধতি থাকলেও, সেখানে এলজিবিটি অধিকার, মদ, জুয়া, ক্যাসিনো সবকিছু বৈধ। বাংলাদেশ কি তা অনুসরণ করতে প্রস্তুত?
পি.আর. পদ্ধতি ছোট দলের জন্য ভালো—এ কথা মেনে নিলেও, এভাবে সাংবিধানিক কাঠামো ও রাজনৈতিক বন্ধোবস্ত ভেঙে ফেললে রাষ্ট্র মাফিয়ার হাতে চলে যাবে বলে তিনি সতর্ক করেন।
রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও রাষ্ট্র কাঠামোর প্রশ্ন
ডা. পিনাকীর বক্তব্যে উঠে এসেছে ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’-এর মতো একটি তাত্ত্বিক মডেল, যেখানে রাজনৈতিক দল, পুলিশ, আমলা, বিচারক, মাস্তান, ব্যবসায়ী সবার একটি অলিখিত বোঝাপড়ার মধ্যেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়।
এই কাঠামো ভেঙে দিলে সমাজে ভারসাম্য হারাবে—উঠে আসবে অপরাধ, সহিংসতা, দখলদারি ও প্রশাসনিক কর্তৃত্বের দাপট। ফলে রাষ্ট্র রাজনৈতিক দলের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।
উদাহরণ হিসেবে আফগানিস্তানের তালেবান-পূর্ব পরিস্থিতি, ইসরায়েল ও বেলজিয়ামের আঞ্চলিক উত্তেজনা তুলে ধরে তিনি বলেন, সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন কাঠামোকে অস্থিতিশীল করবে এবং পুলিশের হাতেই রাষ্ট্র চলে যাবে।
সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বের একটি বিকল্প উপায় হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে এই মুহূর্তে তা চালু করার মতো রাজনৈতিক ঐকমত্য, সাংবিধানিক প্রস্তুতি বা সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কি আদৌ আছে?
নাকি এটি কেবল একটি ধূসর রাজনৈতিক কৌশল—যা একনায়কতন্ত্রের আরেকটি রূপ? নির্বাচন সংস্কার না হয়ে যদি এটি হয়ে ওঠে ক্ষমতার বিকেন্দ্র থেকে পুনরায় কেন্দ্রীকরণের হাতিয়ার, তবে তা দেশের গণতন্ত্র ও নিরাপত্তার জন্য নতুন সংকট বয়ে আনবে।