দুদককের তদন্ত থামাতে বিশেষ সহকারীর চিঠি, , দেড়শ কোটির প্রকল্পে ব্যয় ৩২৬ কোটি টাকার পরিকল্পনা

মাত্র ২৬ টেরাবাইট ব্যান্ডউইথ চাহিদা থাকলেও কেনা হচ্ছে ১২৬ টেরাবাইট সক্ষমতার যন্ত্রপাতি, তাও ৩২৬ কোটি টাকায়—যেখানে বুয়েট বলছে ১৬৫ কোটিতেই কাজ শেষ হতো। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আপত্তি ও অনুসন্ধানের মাঝেও এই ব্যয়বহুল প্রকল্প এগিয়ে নিতে চেষ্টার পেছনে উঠে এসেছে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের নাম, যিনি নিজ প্যাডে দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে প্রকল্পটির পক্ষে সাফাই গেয়েছেন।

বুয়েটের সমীক্ষা বলছে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ ব্যান্ডউইথ চাহিদা ২৬ দশমিক ২ টেরাবাইট। সেই চাহিদা মেটাতে ১০০জি লাইন স্থাপন যথেষ্ট, যার জন্য ১৬৫ কোটি টাকা খরচেই কাজ শেষ করা যেত। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহার করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ৪০০জি লাইনের যন্ত্রপাতি কিনতে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়, যার ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ।

প্রকল্পের বিরোধিতা করায় তৎকালীন বিটিসিএল ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে করা হয় বিভাগীয় মামলা, যদিও পরে আদালতের আদেশে সেগুলো স্থগিত হয়। কিন্তু এরপরই হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেডকে কার্যাদেশ দেওয়া হয় সচিবের পৃষ্ঠপোষকতায়, অভিযোগ উঠেছে, এতে বিদ্যমান নীতিমালা উপেক্ষিত হয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধান বলছে, পুরো প্রকল্পজুড়ে রয়েছে গোপন লুটপাটের প্রক্রিয়া—অপ্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, গোপনীয়তা লঙ্ঘন এবং বুয়েটের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে চার গুণ বেশি সক্ষমতার যন্ত্রপাতি কেনার চেষ্টা। এসব প্রমাণ পেয়ে দুদক সরাসরি জানিয়ে দেয়, “এ প্রকল্পের ক্রয় প্রক্রিয়ার অবশিষ্ট কার্যক্রম চালিয়ে নিলে তা আইনের ব্যত্যয় হবে”।

এই অবস্থায় গত ২২ জুন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব নিজ প্যাডে দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি পাঠিয়ে বলেন, “দেশের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় ফাইভ-জির রেডিনেস পিছিয়ে পড়া রোধ, প্রযুক্তিগতভাবে বিটিসিএলের পিছিয়ে পড়া রোধ, এডিপি বাস্তবায়নের হার নিশ্চিত করাসহ নানা কারণে এই প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রাখা একান্ত প্রয়োজন।”

তিনি আরও যুক্তি দেন, “দেশের বর্তমান ইন্টারনেট ফুটপ্রিন্ট প্রায় ৩৫ টেরাবাইট এবং ইন্টারনেট ক্যাপাসিটির চাহিদা বৃদ্ধির বার্ষিক হার প্রায় ৫০ শতাংশ। এমতাবস্থায় আগামী এক যুগের চাহিদার আলোকে ১২৬ টেরাবাইটের ক্যাপাসিটি মোটেই বেশি নয়, বরং ২৬ টেরাবাইটের হিসাব ভুল এবং অপরিণামদর্শী।”

তবে দুদকের এক শীর্ষ কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, “এ প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা ক্রিমিনাল অফেন্স। দুর্নীতি দমন কমিশন মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাব দেওয়ার পরও বিশেষ সহকারী নিজ প্যাডে চিঠি দিয়ে মূলত দুদককেই প্রচ্ছন্ন হুমকি দিলেন। এ ধরনের কার্যক্রম দুদকের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল।”

দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মইদুল ইসলাম বলেন, “এ ধরনের চিঠি দেওয়া উচিত নয়। এতে দুদক বিব্রত হয়। দুদক তো প্রকল্প চালিয়ে নিতে বলতে পারে না। আর প্রকল্প চালিয়েই বা নেবে কীভাবে, যদি সেই প্রকল্পের অনুমোদনই আইনসংগত না হয়?”

এদিকে হুয়াওয়ের সাউথ এশিয়ার কমিউনিকেশন প্রধান তানভীর আহমেদ বলেন, “আমরা তো বৈধভাবেই সব নিয়ম-কানুন মেনেই কাজটা পেয়েছি।” দুদকের আপত্তি নিয়ে তিনি বলেন, “সম্প্রতি দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন হুট করে একটা চিঠি দিয়ে বলেছেন যে, প্রকল্পে দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে। এটা উনি কিসের ভিত্তিতে বললেন?”

তবে খোরশেদা ইয়াসমীন শুধু মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাব দিয়েছেন বললে তানভীর বলেন, “তাহলে উনি ওএসডি হলেন কেন?”

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবও বলেন, “আমি আমাদের দুদক চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চিঠি দিয়েছি। সেটা আমি ব্যাকগ্রাউন্ডসহ ব্যাখ্যা দিয়েছি। প্রকল্পটা যদি না হয়, তাহলে আমাদের ২৯০ কোটি টাকার যে এলসি পেমেন্ট হয়ে গেছে, সেটা মার যাচ্ছে। পাশাপাশি একই কাজ নতুন করে করলে লাগবে ৬০০ কোটির বেশি। মানে রাষ্ট্রের ৯০০ কোটি টাকা যাবে।”

তিনি আরও বলেন, “আমি অর্থ ছাড় করিনি। রাষ্ট্রের অর্থ গচ্চা গেছে অনেক আগেই। এখন যদি দুদক মনে করে টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অনিয়ম হয়েছে, তাহলে তারা অবশ্যই শাস্তি দিতে পারে। তবে আমরা সন্দেহ করি, কিছু বেসরকারি মাফিয়া বিটিসিএলকে ট্রান্সমিশন ব্যবসা থেকে সরিয়ে দিতে চায়।”

এ বিষয়ে টিআইবি (Transparency International Bangladesh) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রশ্ন হচ্ছে প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার যৌক্তিকতা নির্ধারণে যথাযথভাবে কস্ট-বেনিফিট ও ঝুঁকি বিশ্লেষণ করা হয়েছে কি না। হুয়াওয়ে নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু একসঙ্গে বিতর্কিতও। এলসির অর্থ লোকসানের যুক্তিতে প্রকল্প এগিয়ে নিলে আরও বড় আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, “দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্তের কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া বা তদন্ত প্রক্রিয়া প্রভাবিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।” সূত্র : কালবেলা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *