মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর (Mirza Fakhrul Islam Alamgir) বলেছেন, বিএনপিকে ‘সংস্কারবিরোধী’ হিসেবে প্রচার করা একটি সুপরিকল্পিত অপচেষ্টা, যা একটি বিশেষ মহল পরিচালনা করছে। রোববার সকালে রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব মন্তব্য করেন তিনি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই—সংস্কারের পক্ষে বিএনপির দৃঢ় অবস্থান রয়েছে। এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। কিন্তু দুঃখজনকভাবে কিছু গণমাধ্যম এবং ব্যক্তি বিভ্রান্তিকর কথা বলছে, যেগুলোর বাস্তবতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই।”
তিনি দাবি করেন, বিএনপি গত ১৫ বছর ধরে ভোটাধিকার, বাকস্বাধীনতা এবং ন্যায়বিচারের অধিকারের জন্য লড়াই করে আসছে। নির্বাচনের মাধ্যমেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যেতে চায় দলটি। “আমরা কোনো ষড়যন্ত্র বা বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চাই না, জনগণের ভোটেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে চাই,” বলেন মির্জা ফখরুল।
ঐকমত্য কমিশন: প্রত্যাশা, হতাশা ও জট
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে জনমনে যেমন আগ্রহ রয়েছে, তেমনি বেড়েছে উদ্বেগও। মির্জা ফখরুল জানান, বিএনপি অনেক ক্ষেত্রেই ছাড় দিয়ে কমিশনের উদ্যোগে সহযোগিতা করেছে। তবে, দীর্ঘ আলোচনার পরও কিছু কমিশন নিজেদের পেশ করা প্রস্তাব বাদ দিয়ে নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করছে, যা অচলাবস্থা তৈরি করছে এবং সংস্কার প্রক্রিয়া বিলম্বিত করছে।
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, নির্বাচিত সংসদ বা সরকারকে দুর্বল করার নামে কিছু প্রস্তাব আনা হয়েছে, যা আসলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।”
সংস্কার প্রস্তাবগুলোতে বিএনপির অবস্থান
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বিএনপির অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি জানান:
- দুদক সংস্কার কমিশনের ৪৭টি প্রস্তাবের মধ্যে ৪৬টিতে একমত, কেবল ২৯ নম্বর প্রস্তাবে ভিন্নমত, যেখানে আদালতের অনুমতির বিধান রাখতে চায় বিএনপি।
- জনপ্রশাসন কমিশনের ২০৮টি প্রস্তাবের মধ্যে ১৮৭টিতে একমত, ৫টিতে আংশিক একমত এবং ১১টিতে ভিন্নমত।
- বিচার বিভাগীয় কমিশনের ৮৯টি সুপারিশের মধ্যে ৬২টিতে একমত, ৯টিতে আংশিক একমত, ১৮টিতে যুক্তিসমেত ভিন্নমত।
- নির্বাচনী ব্যবস্থাবিষয়ক সংস্কারে ২৪৩টি সুপারিশের মধ্যে ১৪১টিতে একমত, ১৪টিতে আংশিক একমত এবং ৬৪টিতে ভিন্নমতসহ একমত।
- সংবিধান সংস্কার কমিশনের ১৩১টি সুপারিশের বেশির ভাগে একমত। এর মধ্যে বিতর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণের প্রস্তাবেও ছাড় দিয়েছে বিএনপি।
এছাড়াও, বিএনপি (BNP) সংসদে বিরোধী দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটির সভাপতির পদ দেয়ার প্রস্তাবেও একমত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা সংশোধন সম্পর্কিত আর্টিকেল ৪৯ নিয়েও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও জাতীয় প্রতিষ্ঠান
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল, ন্যায়পাল আইন যুগোপযোগী করা এবং জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণে সাংবিধানিক সংশোধনের বিষয়েও বিএনপি একমত হয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশন নিয়ে এখনও আলোচনা শুরু হয়নি, তবে প্রাথমিকভাবে র্যাব বিলুপ্তিসহ প্রায় সব বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে উঠেছে বলে জানান ফখরুল।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্ষমতার বিপদ
মির্জা ফখরুল বলেন, “রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। তাদের প্রত্যাশা বা প্রতিনিধিত্ব না করে কোনো ব্যক্তি, দল কিংবা কমিশনের একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকা উচিত নয়। কেউ যদি মনে করে নির্বাচিত সংসদ বা সরকারকে দুর্বল করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে—তাহলে তারা এক বড় ভুল করছে।”
তিনি আরও বলেন, “ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দিলে যেমন ফ্যাসিবাদ জন্ম নেয়, তেমনি সংসদ ও সরকারকে ক্ষমতাহীন করলে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে।”
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ (Salahuddin Ahmed) এবং নজরুল ইসলাম খান (Nazrul Islam Khan) উপস্থিত ছিলেন এবং বক্তব্য রাখেন।