তরুণদের চোখে রাজনীতি: শহর-গ্রামে সমানভাবে জনপ্রিয় বিএনপি

দেশের তরুণ সমাজের রাজনৈতিক পছন্দ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (SANEM) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে চমকপ্রদ সব তথ্য। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ২ হাজার তরুণ-তরুণী অংশ নিয়েছেন এই গবেষণায়, যা পরিচালিত হয়েছে দেশের আটটি বিভাগকে অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিটি বিভাগ থেকে বাছাই করা হয়েছে দুটি জেলা এবং প্রতিটি জেলা থেকে দুটি উপজেলা।

জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪০ শতাংশের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসির নিচে এবং বাকি ৬০ শতাংশ এসএসসি বা তার ওপরে শিক্ষিত। শহর ও গ্রাম—উভয় জায়গা থেকেই সমান সংখ্যক তরুণ এই জরিপে অংশ নেন।

রাজনৈতিক সমর্থনে স্পষ্ট পার্থক্য

জরিপের রাজনৈতিক অংশে দেখা গেছে, তরুণদের ভোটে সবচেয়ে এগিয়ে বিএনপি (BNP)। ছেলেদের মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে ৩৭ দশমিক ০৩ শতাংশ বিএনপিকে ভোট দিতে চান। দ্বিতীয় অবস্থানে জামায়াতে ইসলামি (Jamaat-e-Islami) — ছেলেদের মধ্যে ২২ দশমিক ২১ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে ২০ দশমিক ৫৭ শতাংশ তাদের সমর্থন করেছেন।

তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (National Citizens’ Party – NCP)। পুরুষ ভোটারদের মধ্যে ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে ১৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ এনসিপিকে পছন্দের তালিকায় রেখেছেন।

শহর বনাম গ্রাম: বিএনপির অবস্থান শক্ত

গ্রামীণ তরুণদের মধ্যে বিএনপির প্রতি সমর্থন ৩৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, জামায়াতের ২১ দশমিক ২৫ এবং এনসিপির ১৫ দশমিক ৩৮ শতাংশ। অন্যদিকে শহুরে তরুণদের মধ্যে বিএনপির ভোট ৩৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ, জামায়াতের ২১ দশমিক ৬৬ এবং এনসিপির ১৬ দশমিক ২৮ শতাংশ।

আলোচনার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আওয়ামী লীগ (Awami League) – এক সময়ের ক্ষমতাসীন দলটির প্রতি সমর্থন এখন তুলনামূলকভাবে কম। গ্রামীণ তরুণদের মধ্যে ১৬ দশমিক ৬২ শতাংশ এবং শহরের তরুণদের মধ্যে ১৩ দশমিক ৪৬ শতাংশ এখনো তাদের ভোট দিতে পারেন বলে জানিয়েছেন।

মব জাস্টিস ও সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ

‘যুবসমাজের পরিবর্তন: চাকরি, শিক্ষায় এবং জুলাই আন্দোলনের পর বদলানো রাজনৈতিক দৃশ্যপটে চলার পথ’ শীর্ষক জরিপে সামাজিক নিরাপত্তা, সহিংসতা ও প্রশাসনিক অনিশ্চয়তা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়। এতে ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ মব জাস্টিস বা গণপিটুনির ঘটনা বেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন। ১৫ দশমিক ১ শতাংশ নিরপেক্ষ এবং ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ মনে করেন, এসব ঘটনার প্রভাব নেই তাদের জীবনে।

আগুন লাগানো, ডাকাতি ও চুরির মতো অপরাধ নিয়ে উদ্বিগ্ন ৮০ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ। রাজনৈতিক সহিংসতা ও ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ। আর রাজনৈতিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট গ্রেফতার বা মামলার ফলে দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়ছে বলে জানান ৫৬ দশমিক ২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী।

পরীক্ষার সময়সূচি ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা

সরকারি পরীক্ষার সময়সূচি নিয়ে অনিশ্চয়তা প্রসঙ্গে ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ একমত হয়েছেন যে, এটি তাদের জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করছে। এছাড়া, ৫৩ দশমিক ৬ শতাংশ মনে করেন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা তাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ২৮ দশমিক ২ শতাংশ নিরপেক্ষ ও ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ একমত নন।

গবেষণা দলে কারা ছিলেন?

এই জরিপটি পরিচালনা করেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রাইহান (Selim Raihan)। তাঁর সঙ্গে ছিলেন একরামুল হাসান, শাফা তাসনিম, এশরাত শারমিন, নীলাদ্রি নভিয়া নভেলি এবং মো. রজিব।

সামগ্রিকভাবে বলা যায়, এই জরিপ তরুণ সমাজের বর্তমান মানসিক অবস্থার একটি পরিপূর্ণ প্রতিচিত্র তুলে ধরেছে—যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা ও সামাজিক অনিশ্চয়তা মিলেমিশে তৈরি করছে এক নতুন বাস্তবতা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *