“গণতন্ত্র চাই, কিন্তু নির্বাচন চাওয়া যাবে না”—এমন দ্বন্দ্বময় বাস্তবতাকে চিহ্নিত করে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান আজ সরাসরিভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, “এখন নির্বাচন ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ নেই।” রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় তিনি বলেন, নির্বাচন বিলম্বিত করার প্রচেষ্টা যতোই চলুক, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে একটি অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই।
‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি নির্বাচন প্রশ্নে বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের দ্বিমুখী অবস্থানের সমালোচনা করেন। জাহেদ বলেন, “নির্বাচনকে ঠেকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, কারণ কিছু মানুষের তাতে সুবিধা আছে। দেশে নৈরাজ্যকর অবস্থা তৈরি হলে, কিছু পক্ষ লাভবান হয়। কিন্তু জনগণের চরিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে যদি আমরা সামনে নির্বাচন না দেখি।”
বৈঠকের শুরুতে উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
নির্বাচনের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করে জাহেদ বলেন, “আমি দুঃখিত, নির্বাচনকে খাটো করা একটা বিপজ্জনক প্রবণতা। নির্বাচনের ধারাবাহিকতা থাকলে দেশের রূপান্তর অনিবার্য। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে পরিবর্তন আসে, এটিই ইতিহাসের শিক্ষা।”
তিনি আরও বলেন, “নির্বাচন না হলে, কিছু দল হয়তো জিতবে না—তবু নানা জায়গায় তারা প্রভাব খাটাতে পারছে। পদায়ন, বদলি, টেন্ডার—সবখানে তদবির চলছে। এই ক্ষমতার ব্যবস্থাটাই এখন নির্বাচনের বিলম্বের পেছনে বড় চালিকা শক্তি।”
জাহেদ উর রহমান মন্তব্য করেন, “সবকিছু যদি আমরা একসাথে বিচার করি, আমরা খুব ভালো অবস্থানে নেই। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, বলা যায়—নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নির্বাচনের বদলে নিরাপত্তাকে অজুহাত বানিয়ে দেরি করানো হচ্ছে।”
‘হাতুড়ির বাড়ি দিয়ে দেশ ঠিক করা যায় না’
সংস্কার কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে জাহেদ বলেন, “আমি সংস্কার নিয়ে খুব আশাবাদী নই। তবে বিচার বিভাগের পূর্ণ পৃথকীকরণ ও সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে যে মোটামুটি ঐকমত্য হয়েছে, সেটা ছোট অর্জন নয়। বিএনপিও এ বিষয়ে সহমত।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ এখন একটি অ্যাকিউট ইমার্জেন্সি অবস্থায় আছে। নির্বাচনটা যেন লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীর বাঁচার একমাত্র পথ। এরপর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা লাগবে। কেউ যদি ভাবে, কামারের হাতুড়ির মতো এক ঘা দিয়ে সব ঠিক করে ফেলবে—তাহলে সে বিভ্রান্ত। এসব ধাপে ধাপে করতে হবে।”
‘খোয়াব’ আর ‘রেড গার্ড’ ভাবনার সমালোচনা
জুলাইয়ের অভ্যুত্থান–পরবর্তী রাজনৈতিক বাস্তবতা নিয়েও সরব হন জাহেদ। তিনি বলেন, “আমরা আসলে গিয়েছিলাম একটি কাঠামোহীন ও অসংগঠিত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। সফল হয়েছি বটে, কিন্তু পরবর্তীতে সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারিনি। বরং অনেকে সেই মুহূর্তে নিজেদের চিন্তা ও এজেন্ডা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।”
তার ভাষায়, “কেউ কেউ ভেবেছেন, সংবিধান স্থগিত করে একক সিদ্ধান্তে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব। কিন্তু ক্ষমতাবান রাজনৈতিক শক্তিকে এভাবে বাদ দিয়ে কোনো সরকার চলে না। তারা প্রতিরোধ করবেই। যখন বুঝেছে তাকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, তখন প্রবল প্রতিরোধে নেমেছে।”
জাহেদ বলেন, “জুলাই বিপ্লব বলে আমরা যেটিকে মনে করছি, সেটি বাস্তবে একটা কাঠামোবিহীন উদ্যোগ ছিল। এখনো কেউ কেউ মনে করছেন শিক্ষার্থীদের ‘রেড গার্ড’ বানানো যেতে পারে। এই স্বপ্ন বা খোয়াব আমাদের সমস্যা বাড়িয়ে দিচ্ছে।”
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই আলোচনায় আরও অংশ নেন লেখক ও চিন্তক ফরহাদ মজহার, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, গবেষক হোসেন জিল্লুর রহমান, আইনজীবী সারা হোসেন, গবেষক আলতাফ পারভেজ, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, মাহা মীর্জা, তরুণ গবেষক সহুল আহমদ প্রমুখ।
এ আলোচনায় উঠে এসেছে একটি স্পষ্ট বার্তা: কোনো জটিল রাজনৈতিক রূপরেখা বা সংস্কার প্রকল্পই অর্থবহ হবে না, যদি নির্বাচনের মতো মৌলিক গণতান্ত্রিক অনুশীলন অবহেলিত হয়।